ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

লকডাউন মডেল টোলারবাগ

লকডাউন মডেল টোলারবাগ

রাজধানীর টোলারবাগে বেশ কড়াকড়িভাবেই চলছে লকডাউন। এর সুফলও পাচ্ছেন এলাকাবাসী- মাহবুব হোসেন নবীন

জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২০ | ১২:০০

লকডাউনের নির্দেশনা কঠোরভাবে পালন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর উদাহরণ হয়ে উঠেছে রাজধানীর টোলারবাগ। কভিড-১৯ বিস্তৃতির প্রাথমিক পর্বে মিরপুরের এই এলাকা ছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। সময়ের পরিক্রমায় এটিই এখন অন্যতম স্বস্তির জায়গা। অন্যদিকে লকডাউনের নির্দেশনা উপেক্ষা করায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অল্পদিনেই অনেক বিস্তৃতি পেয়েছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস।
প্রতিদিন কভিড-১৯ পরিস্থিতির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। এসব তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, টোলারবাগে সর্বশেষ করোনা শনাক্ত হয়েছে ১০ এপ্রিল। এরপর অন্তত অর্ধশত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু কারও শরীরে কভিড-১৯ শনাক্ত হয়নি। অন্যদিকে টোলারবাগে করোনায় দু'জনের মৃত্যু এবং কয়েকজন শনাক্তের সময় আলোচনায়ই ছিল না, এমন বেশ কিছু এলাকা বিচ্ছিন্নভাবে এ রোগের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে।
ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক এক অধ্যক্ষ মারা যাওয়ার পর আলোচনায় আসে টোলারবাগ। ২১ মার্চ মারা যান সত্তরোর্ধ্ব ওই ব্যক্তি। দু'দিনের মাথায় তার আরেক প্রতিবেশীও মারা যান। ২৩ মার্চ থেকে কঠোরভাবে লকডাউন কার্যকর করে টোলারবাগবাসী।
টোলারবাগের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, প্রথমদিকে লকডাউনের নির্দেশনা না মানায় ওই এলাকায় বেশ কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন। এখন এলাকাবাসী কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। কারও মধ্যে করোনার মতো উপসর্গ দেখা দিলে তিনি হাসপাতালে যাচ্ছেন না, আইইডিসিআরের প্রতিনিধি এসে নমুনা নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ৪ এপ্রিল পর্যন্ত টোলারবাগে মোট শনাক্তের সংখ্যা ছিল ছয়জন। ৯ এপ্রিল সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ জন। পরদিন আরও পাঁচজন যোগ হলে সেখানে মোট শনাক্তের সংখ্যা হয় ১৯ জন। এরপর নতুন করে আর কেউ শনাক্ত হয়নি। সর্বশেষ গত ১৩ এপ্রিল ৪২ জনের নমুনা নিয়েছিল আইইডিসিআর। তবে একজনেরও কভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়া যায়নি।
তথ্য বিশ্নেষণ করে জানা যায়, ২১ মার্চ টোলারবাগে প্রথম একজনের মৃত্যুর ঘটনার দিন সারাদেশে করোনা শনাক্ত হয় ২৪ জনের। ২৩ মার্চ টোলারবাগে দ্বিতীয় মৃত্যু পর্যন্ত সারাদেশে মোট শনাক্ত ছিল ৩৩ জন। এরপর পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় করোনা বিস্তৃত হতে থাকে। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত টোলারবাগে ১৯ জন শনাক্তের সময় রাজধানীর ওয়ারীতে ১৩, মোহাম্মদপুরে ১১, বংশালে চার এবং চকবাজারে তিনজন শনাক্ত হয়েছিল।
তবে ১১ এপ্রিল থেকে বদলে যেতে থাকে পরিসংখ্যান। টোলারবাগে নতুন কেউ শনাক্ত না হলেও রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। ২২ এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য বিশ্নেষণে দেখা যায়, ওয়ারীতে ৩০, মোহাম্মদপুরে ৪৪, বংশালে ৩৪ এবং চকবাজারে ৩২ জনের মধ্যে করোনা পজিটিভ মিলেছে। এ ছাড়া টোলারবাগ নিয়ে দুশ্চিন্তার সময় আলোচনাতেই ছিল না- এমন কয়েকটি এলাকার মধ্যে ধানমন্ডিতে ২৬, রাজারবাগে ৭০, তেজগাঁওয়ে ২৪, উত্তরায় ২৫, লালবাগে ৩৯, গেন্ডারিয়ায় ২২, মিটফোর্ডে ২৮, শাঁখারীবাজারে ২০ এবং আজিমপুরে ১৬ জন শনাক্ত হয়েছে।
পুরান ঢাকার লালবাগ, বংশাল, গেন্ডারিয়া, মিটফোর্ড, চকবাজারে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, এসব এলাকায় গলির দুই পাশে লকডাউনের সাইনবোর্ড টানিয়ে বাঁশ দিয়ে রাস্তা আটকে দেওয়া হলেও ভেতরে আড্ডা বন্ধ হয়নি। বাসিন্দারা দিনের বেলায় ইচ্ছামতো ঘোরাফেরা করছেন। খোলা রয়েছে স্থানীয় দোকানপাট। লকডাউনের নির্দেশনা মানাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। অথচ আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিনই এসব এলাকায় নতুন নতুন কভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হচ্ছে।
লকডাউনের বিষয়ে টোলারবাগ বাড়ি মালিক সমিতি ইয়ুথ সোসাইটির সভাপতি রিয়াদ খান বলেন, পরিস্থিতির ভয়াবহতা সবাইকে বোঝানো গিয়েছিল। তাই বাসিন্দারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কঠোর নির্দেশনা মেনে চলেছেন। অবশ্য গোড়ার দিকে কয়েকদিন নির্দেশনা ভঙ্গ না করলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও কম হতো। তবু অন্য এলাকায় যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, সে তুলনায় টোলারবাগ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
টোলারবাগের বাসিন্দা মাহফুজ আলম জানান, লকডাউনের পর মাত্র একদিন জরুরি প্রয়োজনে তিনি এলাকার বাইরে
গিয়েছিলেন। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই তাকে ভেতরে ঢোকানো হয়েছিল। অবশ্য সম্প্রতি এখানে সামাজিক দূরত্ব মানার ক্ষেত্রে খানিকটা শিথিলতা দেখা গেছে। অনেকে নানা প্রয়োজনে বাসার নিচে নামছেন। বাজার-সদাই করছেন। যদিও মাঝখানে কিছুদিন বাসিন্দারা বাইরে যাওয়া দূরে থাক, বাসার নিচে গলিতেও নামেননি। বিশেষ করে দু'জন মারা যাওয়ার পর পুরো এলাকায় ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
তিনি জানান, টোলারবাগের যে সড়কগুলো ব্যবহার করে অন্য সড়কে আসা-যাওয়া করা হয়, সেগুলো এখন বন্ধ রয়েছে। দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে। রাস্তা বা বাসার সামনে আড্ডাও নেই। নিয়ম করে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে যায় সিটি করপোরেশনের গাড়ি। সবমিলিয়ে টোলারবাগে লকডাউন খুবই কার্যকর হয়েছে। সারাদেশেই এভাবে লকডাউনের নির্দেশনা কঠোরভাবে কার্যকর করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

×