সোমবার দুপুরে নিজ দোকানে পড়ে থাকা সব ভাঙা কাচ সরাচ্ছিলেন অমল চন্দ্র শীল। হেয়ারক্রাফট নামে একটি সেলুন রয়েছে তার। মগবাজারে আড়ংয়ের উল্টো পাশে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত তিনতলা ভবনের ঠিক পেছনে অমলের সেই সেলুন। গতকালও তার চোখে-মুখে আতঙ্ক। তিনি বলেন, 'ধুম করে শব্দ হওয়ার পরপরই কাচ ভেঙে মাথার ওপর পড়ছিল। দ্রুত চেয়ারের নিচে মাথা লুকাই। পরে বাইরে বেরিয়ে দেখি অনেক মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় এদিক-সেদিক পড়ে আছে।'
হঠাৎ বিস্ফোরণের পর গতকালও মগবাজার ও আশপাশ এলাকার বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ীদের ঘোর কাটেনি। দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির কাচ, দরজা-জানালা ভেঙে চুরমার। মূল ঘটনাস্থলের চারপাশে অন্তত এক কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্ম্ফোরণের শব্দ ও এর প্রতিক্রিয়ায় ক্ষয়ক্ষতি হয়। কীভাবে, কেন তীব্র এই বিস্ফোরণ- এমন প্রশ্ন সবার মাঝে। অনেকে তিতাসের লাইনকে সন্দেহের তালিকায় রাখছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বোমা নিষ্ফ্ক্রিয়করণ দলের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাইপলাইনের ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে (লিকেজ) বিস্ম্ফোরণের সূত্রপাত। গ্যাস জমে জমে ভবনের ভেতরের কোনো কক্ষে 'গ্যাস চেম্বার' তৈরি হয়। এরপর কোনো সিগারেট বা অন্য কোনো মাধ্যমে আগুনের সংযোগের পর তা বিকট শব্দে বিস্ম্ফোরিত হয়।
প্রতিবেদনে এটিকে প্রাকৃতিক গ্যাস, মিথেন বা হাইড্রোকার্বন গ্যাসের বিস্ফোরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসি বা এ ধরনের কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের বিস্ম্ফোরণে সাধারণত এত বিকট শব্দ হওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ম্ফোরণেও এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না। আর একই সময় একাধিক সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও ঘটেনি। ভবনের ভেতর থেকে অক্ষত অবস্থায় গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া গেছে। তবে ভবনে বাতাস চলাচল ব্যবস্থা (ভেন্টিলেশন) থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হতো।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন সমকালকে বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে তিন ধরনের গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছি। তা হলো- মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ও ফসজিন। ধারণা করছি, এতগুলো গ্যাস একসঙ্গে মিশে যাওয়ায় ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটেছে। তিতাসের লাইনে মিথেন গ্যাস থাকে। স্যুয়ারেজ লাইনে হাইড্রোজেন সালফাইড পাওয়া যায়। ফসজিন এমন গ্যাস, তা নিজের একার খুব বড় ক্ষতির কারণ হওয়ার ক্ষমতা নেই। তবে অন্য গ্যাসের সঙ্গে মিশে সেটিও ভীতিকর হতে পারে। তিতাস বলছে, ওই ভবনে তাদের বৈধ লাইন নেই। তবে ঢাকায় এমন অনেক জায়গায় গ্যাসের লাইন থাকে, যা তিতাস নিজেও জানে না। সেখানে গ্যাসের লাইন ছিল কি-না এটা আমরা পরীক্ষা করে দেখব।
সাজ্জাদ হোসাইন আরও বলেন, বিধ্বস্ত ভবনের সামনে খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছিল। এতে তিতাসের লাইন কাটা পড়তেও পারে। এ ছাড়া সিসিটিভির ফুটেজে দুর্ঘটনার পর আগুনের স্ম্ফুলিঙ্গ ছড়াতে দেখা গেছে। যতক্ষণ গ্যাস ছিল ততক্ষণ আগুন জ্বলেছে।
গতকাল সোমবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, বোমা হামলা মনে করে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। এখানে একমুখী ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। যদি বিস্ম্ফোরক হতো, তাহলে বহুদিকে, মানে তিন-চারদিকে যেত। তা ছাড়া এ ঘটনায় কাচের টুকরা ছাড়া আমরা অন্য কিছু পাইনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও সেফটি ম্যানেজমেন্ট ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান সমকালকে বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে ৮-৯ শতাংশ মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাছাড়া ঢাকায় তিতাস ও স্যুয়ারেজের লাইন অনেক পুরোনো। সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দায় স্বীকার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা না হলে নারায়ণগঞ্জের তল্লা ও মগবাজারের মতো এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আরও হবে।
এমন ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণ অব্যবস্থাপনা বা অনিয়মের কারণে ঘটছে বলে মনে করেন কিনা- জানতে চাইলে আলী আহাম্মেদ খান বলেন, সারাদেশেই উন্নয়নের কাজ চলছে। এসব কাজে অনেক ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড বা নির্মাণকাজে ফায়ার নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। যে কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
তবে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহর ভাষ্য, ওই ভবনে তিতাসের বৈধ-অবৈধ কোনো সংযোগ নেই। এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ম্ফোরণের কারণে এটা ঘটতে পারে। এলপিজি সিলিন্ডারের কথা কেউ বলছে না কেন? সিলিন্ডার বিস্ম্ফোরণে এত বড় দুর্ঘটনার নজির বিদেশে রয়েছে। আর ঘটনাস্থলে মিথেন গ্যাসের যে অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, সেটা স্যুয়ারেজ লাইনের হতে পারে। এ দুর্ঘটনার জন্য তিতাস দায়ী নয়।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যদিও দাবি করছেন, ওই ভবনে গ্যাসের বৈধ-অবৈধ লাইন নেই। তবে সমকাল নিশ্চিত হয়েছে- সেখানে গ্যাস সংযোগ রয়েছে।
গতকাল দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তরের প্রধান বিস্ম্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ জানান, বিস্ম্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বাতাসে 'হাইড্রোকার্বন' গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আমরা গ্যাস ডিটেক্টর নিয়ে গিয়েছিলাম।
'উৎসটা কী- এখন পর্যন্ত বলা যাবে না। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তা নিশ্চিতের সুযোগও নেই। একটার কারণে আরেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইলেকট্রিক সার্কিটের কারণে কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানে আগুন লাগলে আশপাশের সিলিন্ডার বা ন্যাচারাল গ্যাসের লাইনও এর আওতায় চলে আসে' বলেন আবুল কালাম আজাদ।
ভবন বিধ্বস্ত :গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিধ্বস্ত তিনতলা ভবন ঘিরে উৎসুক মানুষের ভিড়। দোতলায় সিঙ্গারের গুদাম। সেখানে ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম অক্ষত রয়েছে। ভবনের সামনে থাকা একটি জেনারেটর উল্টে পড়ে আছে। ভবনের সামনে লাগানো তিনটি এসির কোনো ক্ষতি হয়নি। ভেতরেও পোড়া কোনো চিহ্ন নেই। তবে ভাঙা কাচ ও দেয়াল ভেঙে ইটের ভাঙা টুকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।
ভবনটির সামনে বিশাল খোলা ম্যানহোল। সেখানে পাশাপাশি স্যুয়ারেজ ও গ্যাসের লাইন স্পষ্ট। সিঙ্গারের মগবাজার শোরুমের সেলসম্যান মো. সোহাগ সমকালকে বলেন, রোববার সন্ধ্যায় ভ্যানে করে ইলেকট্রনিক্স মালপত্র তারা ওপরে তুলছিলেন। এ সময় হঠাৎ বিস্ম্ফোরণ ঘটে। ঈদ উপলক্ষে মাস দুয়েকের জন্য ভবনটির দোতলায় ছোট্ট তিনটি কক্ষ তারা ভাড়া নেন। দু'দিন আগে থেকে গুদামে মালপত্র তুলেছিলেন। গুদামে রাখা কোনো পণ্যের সঙ্গে বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিল না। তাই কোনো পণ্য বিস্ম্ফোরণ থেকে এ ঘটনা ঘটেনি।
ঘটনাস্থল থেকে চারশ গজ দূরে রাইট ভিশন নামে একটি চশমার দোকান। সেটির মালিক আহসান কবীর বাবু বলেন, আশপাশের বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যাদের দরজা-জানালা বন্ধ ছিল তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন বিস্ময়কর দুর্ঘটনা নজিরবিহীন। মগবাজার থেকে এক কিলোমিটার দূরে গাবতলা ও পরীবাগ পর্যন্ত বিস্ম্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। অনেকের বাসার বন্ধ দরজা-জানালা ভেঙে খুলে পড়ে গেছে।
ওই এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, বেশ কিছু দিন ধরেই তারা দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে গ্যাসের গন্ধ পেয়ে আসছিলেন।
তদন্ত কমিটি হলেও মামলা হয়নি :বিস্ম্ফোরণের কারণ খতিয়ে দেখতে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামানকে প্রধান করে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব হলেন পুলিশের বোমা নিষ্ফ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী। কমিটিতে বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধিও রয়েছেন। সাত কার্যদিবসের মধ্যে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আলাদা কমিটি করেছে। ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য দুর্ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডি ছাড়াও পুলিশের আরও একাধিক ইউনিট।
পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি সাজ্জাদুর রহমান বলেন, বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। কোন ধারায় মামলা হবে- এ ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মগবাজারে বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তিন শতাধিক মানুষ আহত হন। এ ছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন একজন।
ফুটেজ :দুর্ঘটনার সময় মগবাজার এলাকার একটি ভবনের সিসিটিভির ফুটেজ সমকালের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যায়, রোববার সন্ধ্যায় মগবাজারের ব্যস্ত সড়কে যানবাহন চলছে। ৭টা ২২ মিনিটের দিকে আগুনের গোলার মতো কিছু রাস্তায় চলাচল যানবাহনের ওপর আছড়ে পড়ছে। এরপর আশপাশের লোকজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন।
বাবার খোঁজ চান হেনা :বিধ্বস্ত ওই ভবনে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করতেন হারুন অর রশিদ (৬৫)। দুর্ঘটনার পর থেকে হারুনের স্বজনরা এখনও তাকে খুঁজে পাননি। তার মেয়ে হেনা বেগম বাবার খোঁজে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন।
হেনা বলেন, 'রোববার বিকেল ৫টার দিকেও একবার কথা হয়। ঘটনার পর সঙ্গে সঙ্গে খুঁজতে বের হন তারা। প্রতিদিন রাত ১০টার দিকে ভিডিও কলে কথা হয়। আমার বাবা কই? ওই ভবনে কেয়ারটেকার হিসেবে প্রায় আড়াই বছর ধরে চাকরি করছিলেন বাবা। একাই একটি কক্ষে সেখানে থাকতেন। বাবার লাশটাও তো পেলাম না!'