রাজধানীর কাকরাইল মোড় থেকে মগবাজার মোড় পর্যন্ত রাস্তায় গাড়ির নিশ্চল সারি ছিল যানজটে। কর্মীদের জন্য অফিসের ভাড়া করা বাস, প্রাইভেটকার, মোটর সাইকেল, পিকআপসহ বারোয়ারি যানবাহনের ভিড় যানজটের কারণ। ফুটপাথেও পথিকের ভিড়। অফিসার্স ক্লাবের সামনে বাড়ি তৈরির সরঞ্জামের ভারী নিয়ে রিকশার অপেক্ষায় থাকা এক ব্যক্তি বললেন, 'লকডাউন কই? সবই চলছে, লকডাউনের নামে খালি খালি কষ্ট দিতাছে'।

কথা হলে ওই ব্যক্তি জানালেন, তার নাম হযরত আলী। অফিসার্স ক্লাবে রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার যানবহন পাচ্ছেন না। সঙ্গে যন্ত্রপাতির ভারী ব্যাগ। হেঁটে যাবেন সেই উপায়ও নেই। পথে বাসে নেই। পূর্ব রামপুরার বৌ বাজার যেতে রিকশা দেড়শ' টাকা ভাড়া চাইছে। ছয়শ টাকা দৈনিক মজুরিতে কাজ করে আসা যাওয়ায় তিনশ টাকা ভাড়া লাগলে-খাবেন কি? পরিবারই চালাবেন কি করে? বাস নেই কিন্তু রাস্তায় নানা গাড়ির যানজট। হযরত আলী বললেন, 'বড় লোকের ভুশ করে যায়। করোনা হয় না। তাইলে বাস চললে সমস্যা কী'।

এই জিজ্ঞাসা কলকারখানা খুলে যাওয়ায় খোলা নানা প্রতিষ্ঠান, দোকান, ব্যবসার কর্মীদেরও। তারা বলছেন, লকডাউন মানা হচ্ছে না। পথে মানুষ আর গাড়িতে সয়লাব। ১১ আগস্ট থেকে গণপরিবহন এমনিতেই চলবে। মানুষকে বিড়ম্বনায় না ফেলে আগেভাগেই লকডাউন উঠয়ে দেওয়া উচিত।

করোনা সংক্রমণ রোধে 'কঠোরতম' লকডাউনের দ্বাদশ দিনে মঙ্গলবার দুপুরে বনানীর বিআরটিএ' প্রধান কার্যালয় থেকে ফার্মগেট হয়ে সেগুনবাগিচা যেতে পথে মহাখালী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিজয়স্মরনী ও বাংলা মোটর মোড়ে গাড়ির ভিড়ে সিগন্যালে পড়তে হয়। বনানী, মহাখালী ও শাহবাগে পুলিশের চেকপোস্ট থাকরেও পথে চলা গাড়িগুলোকে লকডাউনের শুরুর দিনগুলোর মতো তল্লাশি করতে দেখা যায়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন জানিয়েছেন, করোনা বিধিনিষেধ অমান্য করায় ৩৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত ১২০ জনবে এক লাখ ৭৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। ট্রাফিক বিভাগ ৫৩২ টি গাড়িকে ১১ লাখ ২৩ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।
গ্রেপ্তার জরিমানা অব্যহত থাকলেও আগের ১১ দিনের তুলনায় মঙ্গলবারই গাড়ি ও পথচারীর চলাচল বেড়েছে। বড় বড় শপিংমলগুলো না খুললেও অন্যান্য দোকানপাট এবং ছোট মার্কেটগুলো খুলতে শুরু করেছে। দোকানের সাটার অর্ধেক বন্ধ রেখে কেনাবেচা চলছে। হাজারীবাগ ও জিগাতলায় দেখা যায় নিত্যপন্যের দোকানসব সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। জুতা, জামার দোকানও পুরো সাটার খুলেই চলছে। জিগাতলার 'দ্বীপবন্ধু স্টোরের' মালিক নিজাম উদ্দিন জানালেন, কলকারখানা খুলে যাওয়ার পর ক্রেতা বেড়েছে।

তবে প্রধান সড়ক সাত মসজিদ রোডের দুই পাশের দোকানগুলো অর্ধেক বন্ধ রেখে চলছে। সড়কটিতে বেলা তিনটার দিকে প্রাইভেট কারের ভিড় দেখা যায়। ভিড় ছিল রিকশারও। তবে বাস চলাচল করেনি। বাসের অভাবে যেসব অফিস কারখানা খোলা সেগুলোর কর্মীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আগের দিনগুলোর মতোই। বাড়তি ভাড়ায় রিকশা, ভ্যানে চলাচল করতে হচ্ছে।

সাড়ে চারটার দিকে কাওরানবাজারের সোনারগাঁও হোটেলের বিপরীতে ইটিভি ভবনের সামনে দেখা যায়, ভাড়ায় চলায় মোটর সাইকেলের জটলাও ফিরে এসেছে। এখানে চালক নাসির উদ্দিন জানালেন, অ্যাপ এখনো বন্ধ। ক্ষ্যাপে যাত্রী তুলছেন। 'কঠোরতম' লকডাউনের দিকে পুলিশের তল্লাশিতে পথে নামতে পারেননি। আটদিন ঘরে বসে সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে শনিবার থেকে পথে নেমেছেন। যাত্রী পাচ্ছেন মোটামুটি। তেলের খরচ বাদ দিতে দিনে তিন চারশ টাকা থাকছে। গত দুই তিন দিন ধরেও পুলিশও খুব একটা ধরছে না। নাসিরের প্রশ্ন, সবই যখন চলছে তখন অ্যাপ বন্ধ রেখে তার পেটে কেনো লাথি দেওয়া হচ্ছে? এই ঢিলেঢালা লকডাউন রাখার দরকারই কি?

মঙ্গলবারও ঢাকামুখী মানুষের ভিড় ছিল গাবতলী, যাত্রাবাড়িসহ রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে। রাজধানীতে বাস না ঢুকায় আমিনবাজার, হেমায়েতপুরে নেমে ব্যাগ বোচকা নিয়ে হেঁটে আসার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। মহাসড়কে বাস চলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলোতে কয়েকগুণ ভাড়ায় কিংবা ট্রাক পিকআপ সিএনজি অটোরকিশায় বেশি টাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসছেন যাত্রীরা। কর্মস্থলে ফিরতে গিয়ে গরিব মানুষের আয়ের বড় অংশই চলে যাচ্ছে ভাড়ায়।