মোটরসাইকেলে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রাজধানী ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলেছেন মো. মাইনুদ্দিন আরিয়ান। করোনায় জীবন বিপন্ন হওয়া কোনো রোগীর জরুরি ফোন কল পাওয়ামাত্র তার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন অক্সিজেন। এতে রক্ষা পাচ্ছে তার মূল্যবান জীবন।

কেবল আরিয়ান নয়, আরও ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবী তরুণ-তরুণী বেসরকারি সংস্থা 'সুকর্মা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ'-এর এই 'জরুরি অক্সিজেন সেবা' কার্যক্রমে কাজ করছেন। তিনটি মোটরসাইকেলে তারা ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের করোনাক্রান্ত রোগীদের ঘরে বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছেন। ঢাকার বাইরে পাবনা, কুষ্টিয়া ও নাটোরে এই অক্সিজেন সেবা দেওয়া হচ্ছে সিএনজি ও অটোরিকশার মাধ্যমে।

জরুরি অক্সিজেন সেবার কর্মপদ্ধতি বিষয়ে জানা গেছে, করোনাক্রান্ত রোগী ও তাদের স্বজনদের জরুরি টেলিফোন কল (০১৬২৪৭৭৭৯৯৮ এই নম্বরে) আসামাত্রই মোটরসাইকেলে স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে দ্রুত সংশ্নিষ্ট বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া হয়। একেকটি বাসায় প্রয়োজন অনুযায়ী ১৮ দিন, ২১ দিন, এমনকি দুই মাসও অক্সিজেন সিলিন্ডার রেখে সেবা দেওয়া হয়। অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে কর্মীরাই খালি সিলিন্ডারগুলো রিফিল করে দেন অথবা ফিরিয়ে এনে রিফিল করার পর পরবর্তী রোগীর কাছে দিয়ে আসেন।

সুকর্মা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কর্মী আরিয়ান জানান, গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই এই জরুরি অক্সিজেন সেবা দিয়ে আসছেন তারা। এখন পর্যন্ত কেবল রাজধানী ঢাকায় চার শতাধিক করোনা রোগীকে এই সেবা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর গত রমজান থেকে ২৪৫ জনের মতো রোগী অক্সিজেন সেবা পেয়েছেন। আর ঢাকার বাইরের তিন জেলার হাসপাতাল ও বাসাবাড়িতে আড়াইশর মতো অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

ফাউন্ডেশন সূত্র বলছে, জরুরি অক্সিজেন সেবা দিতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের অন্যান্য সহযোগিতাও দিতে হচ্ছে। অনেক সময় অক্সিজেন পৌঁছে দিতে গিয়ে দেখা যায়, রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে হবে। সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডারও লাগবে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। তখন সুকর্মা ফাউন্ডেশনের যে কর্মী সিলিন্ডার নিয়ে গেছেন, তিনিই এসব দায়িত্ব পালন করেন। কাজের পরিসর বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তারা এখন সামর্থ্যবান শুভাকাঙ্ক্ষী কিংবা শিল্পপতিদের কাছ থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স অনুদান পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাব ও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন সহযোগিতা চেয়ে জরুরি টেলিফোন কলের পরিমাণও বেড়েছে। এই সেবা কার্যক্রম চালাতে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসনের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে রাতের জরুরি কলে সহযোগিতা দিতে পুলিশ কর্মকর্তারাও এগিয়ে আসছেন। রাতের জরুরি কলের ক্ষেত্রে এখন মিরপুর, বাড্ডা, ভাটারা, তেজগাঁও, রমনা ও আদাবর থানা থেকেও সুকর্মা ফাউন্ডেশনের অক্সিজেন সিলিন্ডার সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে।

মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে সুকর্মা ফাউন্ডেশন গত সপ্তাহ থেকে 'কেয়ার গিভার' নামের আরেকটি ব্যতিক্রমী কর্মসূচিও শুরু করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় যে বাসা অথবা পরিবারের সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, অথচ সহযোগিতা করার মতো কেউ নেই অথবা নিকট স্বজনরা অন্যত্র অথবা দেশের বাইরে অবস্থান করেছেন- এমন ক্ষেত্রে ফাউন্ডেশনের একজন স্বেচ্ছাসেবী সেই বাসায় সার্বক্ষণিক অবস্থান করে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। বর্তমানে ছয়টি বাসায় পাঁচ-সাত দিন পর্যন্ত অবস্থান করে স্বেচ্ছাসেবীরা এই সেবা দিচ্ছেন।

কেবল জরুরি অক্সিজেন সেবাই নয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র, এমনকি মধ্যবিত্ত অসহায় মানুষকে খাদ্য সহযোগিতাও দিচ্ছে সুকর্মা ফাউন্ডেশন। এরই মধ্যে গুলিস্তান, পলাশী, মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কর্মহীন ভাসমান মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের শুভাকাঙ্ক্ষী একজন উদ্যোক্তা পরিচালিত 'পথের স্কুল'-এর শিক্ষার্থী ও পথশিশুদেরও খাবার দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত।

করোনা শুরুর পর থেকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ৬ নম্বর রোডের ভাঙা মসজিদ ও মিরপুরের কালসী রোড এবং সাভারের কবিরপুরে অবস্থিত তিনটি এতিমখানায় মাসিক খাবার সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে সুকর্মা ফাউন্ডেশন থেকে। এজন্য প্রতি মাসে মাসিক বাজার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া করোনা প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচির আওতায় মানুষকে সচেতন করতে সারাদেশের হাটবাজার, রাস্তা ও অলিগলি এবং গ্রামের মোড়ে মোড়ে প্রচারপত্র বিলি এবং বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ কর্মসূচিও চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। পাবনার নাজিরপুর মাঠপাড়া গ্রামে সম্প্রতি একটি মেডিকেল ক্যাম্পও পরিচালনা করেছে এই ফাউন্ডেশন। যেখান থেকে করোনা রোগীদের চিকিৎসা ছাড়াও বিনামূল্যে ওষুধ ও সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই ঢাকায়ও আরেকটি মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনার চিন্তাও করছেন ফাউন্ডেশন কর্মকর্তারা।

২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সুকর্মা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ মানবতার সেবায় এমন কার্যক্রম চালিয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা শেখ সুহানা। তিনি বলেন, করোনার শুরু থেকে মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। এভাবেই সব সময় মানুষের পাশেই থাকতে চান। যারা ঘরে আছেন, তাদের প্রতি আবেদন থাকবে, সামর্থ্য অনুযায়ী তারাও যেন মানুষকে সহযোগিতা করেন।