- রাজধানী
- জিগাতলার আতঙ্ক 'লাভ লেন' গ্রুপ
জিগাতলার আতঙ্ক 'লাভ লেন' গ্রুপ
ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে কিশোর গ্যাং

পথেঘাটে একা নারী দেখলেই অশ্নীল শব্দ ছোড়ে তারা। নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে। প্রতিবাদ করলে নির্যাতন নেমে আসে। এলাকায় নতুন কোনো ভাড়াটে এলেই মৃদু হুমকি দিয়ে 'মিষ্টি খাওয়ার' টাকা দাবি করে। নববিবাহিত স্বামী-স্ত্রী বাসা ভাড়া নিলে যেন তাদের আর আনন্দের শেষ থাকে না। বাসায় হানা দিয়েই কাবিননামার কাগজ দেখতে চায়, নানাভাবে হুমকি দিয়ে দাবি করে চাঁদা। রিকশায় তরুণ-তরুণী দেখলেই পিছু নেয় এই গ্রুপের সদস্যরা। সব তথ্য পৌঁছে দিতে রয়েছে তাদের 'গোয়েন্দা' দলও। রাজধানীর হাজারীবাগ ও জিগাতলা এলাকায় এভাবেই আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং 'লাভ লেন' গ্রুপের সদস্যরা।
কিশোর গ্যাং লাভ লেনের সদস্যদের অত্যাচারে হাজারীবাগ, জিগাতলা, ট্যানারি মোড়, তল্লাবাগ, তুুলাতলা, চরকঘাটা, মিতালী রোড ও টালি অফিস এলাকার বাসিন্দারা রীতিমতো অতিষ্ঠ। আতঙ্কে কেউ মুখ খোলেন না। গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাখাওয়াত হোসেন জনি।
ওই এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনির নেতৃত্বে থাকা লাভ লেন গ্রুপের সদস্যরা শুধু ভাড়াটেদেরই উত্ত্যক্ত করে না, তারা বাড়ির মালিকদের কাছেও রীতিমতো আতঙ্কের নাম। নতুন বাড়ি তুললে বা কোনো নির্মাণকাজেও তাদের দিতে হয় চাঁদা। সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করেন বাসিন্দারা। গোটা এলাকার মাদক বিক্রির নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। মাদকের কারবারের পাশাপাশি নিয়মিত মাদক সেবনের আড্ডাও বসায় তারা। গ্রুপের অন্যতম সদস্য মালেকের বাসায় চলে মাদক সেবন। পুরো গ্রুপে সক্রিয় রয়েছে ১০ থেকে ১৫ সদস্য।
এলাকা ঘুরে জানা গেল, ওই এলাকায় 'বাংলা গ্যাং' নামেও কিশোরদের একটা গ্যাং রয়েছে। দুই বছর আগে এলাকার মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে লাভ লেন গ্রুপের সঙ্গে বাংলা গ্রুপের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ওই দ্বন্দ্বে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে খুন হয় লাভ লেন গ্রুপের সদস্য কিশোর ইয়াসিন আরাফাত। ওই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের অন্তত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময়ে গ্রুপ দুটি নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে গেলেও দুই বছর ধরে জনির নেতৃত্বে ফের সক্রিয় হয় লাভ লেনের সদস্যরা।
জুলাইয়ে তল্লাবাগের এক বাসায় তার নেতৃত্বে হানা দেয় গ্রুপের সদস্যরা। বাসায় থাকা স্বামী-স্ত্রীর কাছে কাবিননামা চায় তারা। তা দেখাতে রাজি না হওয়ায় তাদের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। শেষ পর্যন্ত বাসার ভেতর ভাঙচুর ও স্বামী-স্ত্রীকে বেদম পেটায় জনির সদস্যরা।
স্থানীয় লোকজন জানায়, ওই ঘটনায় বাসায় ঢুকে হত্যাচেষ্টা, শ্নীলতাহানি ও চুরির অভিযোগে ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ জনিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করলেও তারা পরের দিন জামিনে বেরিয়ে যান। এরপর এলাকার লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কে অনেকটা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ওই দম্পতিও।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হাজারীবাগ এলাকার ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান সমকালকে বলেন, তল্লাবাগের বাসায় ঘটনাটির পর এলাকার সব মুরুব্বি ও বাড়ির মালিকদের নিয়ে তিনি বৈঠক করেছেন। এই ধরনের সন্ত্রাসী-কিশোর গ্যাং কেউ এলাকায় থাকতে পারবে না বলে সবাই মত দিয়েছেন। জনিসহ অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। সবাইকে সাবধান করা হয়েছে, সব অভিভাবককে বলা হয়েছে ছেলেদের নিয়ন্ত্রণ করতে।
কাউন্সিলর বলেন, ডিশ বাণিজ্যসহ নানা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে কিছু উঠতি ছেলে এলাকায় মাতবরি করতে চায়, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। এলাকার বাইরে থেকেও লোকজন এসে দল ভারী করে। তবে সবাই এদের প্রতিহত করবে। এলাকার যারা এ বখাটেদের আশ্রয় দেবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ওই এলাকা ঘুরে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের নেতা সাখাওয়াত হোসাইন জনির নেতৃত্বে লাভ লেন গ্রুপে বর্তমানে মো. আশিক, মো. শরীফ, রায়হান হোসাইন জীবন, মো. শান্ত এবং মো. মালেক সক্রিয় রয়েছে। তারা বয়সে সবাই তরুণ। তবে তাদের অধীনে আরও অন্তত ১০ থেকে ১২ জন কিশোর সক্রিয়। তাদের মধ্যে আশিক থাই গ্লাসের দোকানের কর্মী, শরীফ একটি মার্কেটের দোকানে বিক্রয়কর্মী, শান্ত ও রফিকের নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। রায়হান হাজারীবাগ থানা পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে এলাকায় দাপটের সঙ্গেই চলে। তার মূল পেশা ইয়াবার কারবার। লাভ লেন গ্যাংয়ের সবাই এই মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা প্রকাশ্যে এলাকায় ইন্টারনেট ও ডিশ লাইনের ব্যবসা দেখালেও কিশোরদের দিয়ে ছিনতাইও করে থাকে। রাতে পথচারীদের মোবাইল ফোন ও টাকা কেড়ে নিয়ে উল্টো তাদের পকেটে মাদক দিয়ে পুলিশে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে তল্লাবাগের একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, শান্ত আর রফিক লাভ লেন গ্রুপের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করে। এরা দিনভর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে নতুন ভাড়াটের সন্ধান করে। কেউ নতুন নির্মাণকাজ করল কিনা, এলাকায় কোনো তরুণ-তরুণী একসঙ্গে আড্ডা দিল কিনা, রিকশায় গেল কিনা- এসবের দেখভাল করে ওই দুইজন। এরপর তা জনিকে জানায়। পরে তার নির্দেশে পথে বা বাসায় গিয়ে হানা দেয় দলের সদস্যরা। ডিশ লাইন আর ইন্টারনেটের লাইন মেরামতের কথা বলে বাসায় ঢুকে এরা শুধু স্বামী-স্ত্রী থাকেন, এমন দম্পতি খুঁজে বের করে। এরপর কাবিননামা দেখতে চেয়ে চাঁদা দাবিসহ নানাভাবে হয়রানি করে থাকে।
নাম প্রকাশ না করে একজন বাসিন্দা জানান, তিনি হাজারীবাগের স্কুল রোডে থাকতেন। একদিন কর্মস্থলে যেতে বাসার নিচে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ করেই রায়হানের নেতৃত্বে কয়েকজন তাকে ঘিরে ধরে। তোর কাছে 'মাদক আছে'- এই কথা বলেই মারধর করতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে পুলিশ এসে তাকে থানায় নিয়ে যায়। এরপর তাকে রাতভর নির্যাতন করা হয়। শেষ পর্যন্ত তার পরিবারের সদস্যরা ৩০ হাজার টাকা দিয়ে পরের দিন আদালত থেকে ডিএমপি অ্যাক্টের মামলায় ছাড়া পান।
ওই ব্যক্তি বলেন, আচমকা এমন ঘটনায় তিনি দিশেহারা হয়ে যান। ছাড়া পেয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হান পুলিশের সোর্স। এভাবে অনেককেই পুলিশ দিয়ে হেনস্তা করেছে। গত বছরের শুরুর দিকের ওই ঘটনার পর তিনি আতঙ্কে ওই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বাসা নিয়ে চলে যান।
তল্লাবাগের ভাড়া বাসায় লাভ লেন গ্রুপের হাতে হেনস্তার শিকার তৌহিদ আল আখেরুজ্জামান সমকালকে বলেন, ৫ জুলাই দুপুরে তার স্ত্রী বাজার নিয়ে বাসায় ফেরার পথে অনুসরণ করতে থাকে দুই তরুণ। তারা আপত্তিকর মন্তব্য করলে স্ত্রী প্রতিবাদ করেন। এরপরও ওই দুইজন পিছু নিয়ে বাসা পর্যন্ত আসেন। ওইদিনই রাত ৮টার দিকে জনির নেতৃত্বে ৯ জন আচমকা তার বাসায় ঢুকে কাবিননামা দেখতে চায়। তাদের তা কেন দেখাতে হবে, তা বলতেই মারধর শুরু করে। স্ত্রী এতে বাধা দিলে তার শ্নীলতাহানি করে। ওই ঘটনায় তিনি মামলা করলে পুলিশ তৎপর হয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু এরা পরের দিনই কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে।
আখেরুজ্জামান বলেন, চারজন জামিনে, অপর পাঁচজন গ্রেপ্তার না হলেও সবাই এখন এলাকাতে ঘুরে বেড়ায়। তারা যেন বাসা ছেড়ে দেন এবং ঘটনায় যাতে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া না হয় সে জন্য এরা তার বাড়ির মালিককেও হুমকি দিচ্ছে।
ওই বাড়ির মালিক মো. তুষার বলেন, ঘটনার সময়ে তিনি ছিলেন না। পরে শুনেছেন ওই গ্রুপটি মহল্লার বাইরে থেকে এসে তার বাড়িতে ঢুকেছিল। তিনি এ বিষয়ে আর কথা না বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ভাড়াটে চলে গেলেও তাদের তো এই বাড়িতেই থাকতে হবে। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত শুক্রবার সাখাওয়াত হোসেন জনিকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি।
জানতে চাইলে হাজারীবাগ থানার ওসি মোহা. সাজেদুর রহমান সমকালকে বলেন, ঘটনার পরপরই তারা অভিযান চালিয়ে গ্রুপের অন্যতম প্রধান জনিসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছেন। পলাতকদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের নামে যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করবে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
হাজারীবাগের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনির হয়ে অপকর্ম করা গ্রুপটির কেউই ছাত্রলীগের নয়। কিন্তু দুর্নাম হচ্ছে সংগঠনের। বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতার আশ্রয়ে থাকায় তারাও জনির অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুলতে পারেন না।
মন্তব্য করুন