রাজধানীতে নির্মাণাধীন ভবনগুলোই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ। প্রতিদিন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন পরিচালিত অভিযানেও বেশিরভাগ নির্মাণাধীন ভবনে মিলছে এডিস মশার লার্ভা ও মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ। সিটি করপোরেশন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে যেসব ভবন মালিককে জরিমানা করছে, তাতেও দেখা যাচ্ছে দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে নির্মাণাধীন ভবনের মালিকই বেশি।
সিটি করপোরেশন বলছে, নির্মাণাধীন ভবনগুলোর মালিকদের বারবার সতর্ক করা হলেও তারা সচেতন হচ্ছেন না। নির্মাণাধীন ভবন মালিককে দূষিত পরিবেশের কারণে জরিমানা করার কিছুদিন পর সেই ভবন পরিদর্শনে গিয়ে আবারও এডিস মশার লার্ভা ও বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ পাচ্ছেন সিটি করপোরেশনের পরিদর্শকরা। এসব ভবন মালিক বা ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলোকে বারবার অনুরোধ ও জরিমানা করেও বাগে আনতে পারছে না সিটি করপোরেশন। ফলে এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানাচ্ছে, এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের ৯৯ শতাংশই রাজধানী ঢাকার। গত শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন চার হাজার ৩১৯ জন। এর মধ্যে চলতি মাসের ৭ আগস্ট পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৬৬১ জন। আর জুলাই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন দুই হাজার ২৮৬ জন। সরকারি হিসাবে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১০ জন। এ ছাড়া প্রতিদিনই গড়ে প্রায় ২০০ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এর মধ্যে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার চিত্র বেশ ভয়ংকর। এ পরিস্থিতিকে রীতিমতো উদ্বেগজনক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনার এই মহামারিকালে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহতা নগরবাসীর দুশ্চিন্তাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, লকডাউন বা করোনা মহামারির কারণে অনেক নির্মাণাধীন ভবনের কাজ বন্ধ। সেখানে অনেক সময় কাউকে পাওয়াও যাচ্ছে না। ওই সব ভবনের বেজমেন্ট ও বিভিন্ন তলায় বৃষ্টির পানি জমে থাকছে। সেখানেই জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান বা মালিক সেদিকে নজর দিচ্ছেন না। ওই সব ভবন এডিস মশার বংশবিস্তারের অতি উত্তম পরিবেশ হয়ে উঠছে। বৃষ্টি না হলেও নির্মাণকাজ চলাকালে ব্যবহূত পানিও জমে থাকছে। সেখানেও এডিস মশার বংশবিস্তার হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান সমকালকে বলেন, ৬৫ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনেই এডিস মশার লার্ভা ও মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ পাওয়া
যাচ্ছে। এ জন্য আমরা নির্মাণাধীন ভবনগুলোর দিকে বেশি নজর দিচ্ছি। আর অভিযান ও প্রচারের কারণে বাসাবাড়ির মালিকদের মধ্যে সচেতনতা অনেকটা ফিরেছে। কিন্তু নির্মাণাধীন ভবনগুলোর মালিক ও যুক্ত অনেকের মধ্যে সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা প্রতিদিন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে যাদের জরিমানা করছি, এর মধ্যে বেশিরভাগই দেখা যাচ্ছে নির্মাণাধীন ভবন।
প্রায় একই কথা বলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ। তিনি বলেন, গত জানুয়ারি থেকে মোবাইল কোর্ট, মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করছি। আগে বাসাবাড়ি পরিচ্ছন্ন করার জন্য একটা নামমাত্র ফি ধরা হয়েছিল। পরে সেটা ফ্রি করা হয়েছে। তার পরও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। নির্মাণাধীন ভবনগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ নির্মাণকাজে ব্যবহূত পানি ভবনের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকে। কিন্তু মানুষ যদি সচেতন না হন, তাহলে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক অভিযানে দেখা গেছে, প্রতিদিন যেসব ভবন বা স্থাপনার মালিককে জরিমানা করা হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই নির্মাণাধীন ভবন। ৭ আগস্ট ২০ ভবন মালিককে জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে ১৩টিই নির্মাণাধীন ভবন। ৫ আগস্ট দুই সিটি করপোরেশন ৪৪ ভবন মালিককে ১১ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করে। এর মধ্যে ২৮টিই নির্মাণাধীন ভবন। ৪ আগস্ট ৫১ ভবন মালিককে জরিমানা করা হয়। এসব ভবনের মধ্যে ৩৫টিই নির্মাণাধীন। এ ছাড়া যত অভিযান সাম্প্রতিক সময়ে দুই সিটি করপোরেশন চালিয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগ জরিমানাই করা হয়েছে নির্মাণাধীন ভবন মালিকদের।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে বেশি মাত্রায় এডিস মশার লার্ভা ও মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ যখনই বেশি পাওয়া যাচ্ছিল, তখনই তিনি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে এ ব্যাপারে ডেভেলপারদের সতর্ক থাকার অনুরোধ করা হয়। যেসব নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশার লার্ভা ও মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ পাওয়া যাবে, সেগুলোর মালিকদের জরিমানা করা হবে বলেও জানানো হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, জরিমানা করার কিছুদিন পর সেসব ভবনেই আবার এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করবেন কীভাবে?
সম্প্রতি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামও রিহ্যাব ও বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) নেতাদের নিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি রিহ্যাব ও বিএলডিএ নেতাদের নির্মাণাধীন ভবন ও আবাসন প্রকল্পগুলোতে যাতে এডিস মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ না থাকে, সে ব্যাপারে রিহ্যাব ও বিএলডিএ সদস্যদের নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন। তার পরও সিটি করপোরেশনের অভিযানে নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে এডিস মশার দৌরাত্ম্য বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আল আমিন বলেন, মেয়রের সঙ্গে বৈঠকের পর থেকে প্রতি সপ্তাহে রিহ্যাব সদস্যদের এ ব্যাপারে চিঠি দিচ্ছি, মোবাইলে মেসেজ দিচ্ছি, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিচ্ছি। তাদের বলছি, সাইটগুলো যেন সবাই পরিস্কার রাখেন। নিজ উদ্যোগে এডিস মশার ওষুধ দেওয়ার কথাও বলছি। যাতে পানি জমে না থাকে, সে কথা বলছি। রিহ্যাব সদস্যদের এসব কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, তা মনিটর করতে ছয়টি টিমও করে দিয়েছি। তবে অনেক ছোট কোম্পানি আছে যাদের লোকবলের ঘাটতি আছে। কোরবানির ঈদের আগে এগুলোর শ্রমিকরা বাড়িতে গিয়ে আর ফিরতে পারেনি, তাদের ভবনগুলোতে কিছু সমস্যা হচ্ছে।
এসব প্রসঙ্গে মশক বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জানান, এডিস মশার বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে নির্মাণাধীন ভবন অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু এটিই একমাত্র কারণ নয়। গবেষণায় তিনি দেখছেন, যেসব স্থানে পানি জমা পাত্র পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রায় সব ক'টিতেই এডিসের লার্ভা মিলছে। এখন শুধু নির্মাণাধীন ভবনের কথা বললে নজর কেবল একদিকেই চলে যাবে। তখন অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।