রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালের ভেতরে মূল ভবনের দক্ষিণ পাশে ১২ ফুট লম্বা ও ১০ ফুট চওড়া একটি কক্ষ। এখানে বসে এক সময় রাজস্ব আদায় কার্যক্রম চালাতেন ইজারাদার। ওই ইজারাদার চলে যাওয়ার পর ফাঁকাই পড়ে ছিল কক্ষটি। পাঁচ বছর আগে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী সেখানে ছিন্নমূল পথচারী শিশুদের জন্য চালু করে স্কুল। নিজেরা টাকা দিয়ে এবং সুহৃদদের কাছ থেকে অর্থ, চাল-ডাল, তরি-তরকারি সংগ্রহ করে প্রতিদিন দুপুরে ও রাতে ছিন্নমূল শিশু ও দরিদ্রদের বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হয়। স্কুলটির নাম রাখা হয়েছিল 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অসহায় ছিন্নমূল পথচারী স্কুল'। হঠাৎ স্কুলটির নাম মুছে দিয়ে দরজায় তালা দেওয়া হয়েছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, গত ৭ আগস্ট কয়েকজন শ্রমিক দিয়ে স্কুলের নাম মুছে ফেলা হয়। এর আগে টার্মিনালের ইজারাদারের সহযোগী সাইফুল ইসলাম ও শ্রমিক নেতা কালু শেখ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আমিনুল ইসলামকে ওয়ালে লেখা নাম মুছে ফেলতে বলেন। কিন্তু আমিনুল তা করেননি।

সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে স্কুলটির কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এটি জাতীয়করণের জন্য গত বছর ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করা হয়। অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, এলাকার এমপির সুপারিশ জমা দেওয়া হলে কাজটি সহজ হবে।

স্কুল কমিটির সদস্যরা জানান, তারা ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আগা খান মিন্টুর সুপারিশ চাইবেন। লকডাউনের কারণে এত দিন শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে সুপারিশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। লকডাউন শেষ হওয়ায় সুপারিশের জন্য তারা এমপির কাছে যাবেন।

স্কুলকক্ষের সামনে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে স্কুলটির নাম লেখা ছিল তাতে সাদা রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। দরজায় তালা লাগানো।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আল আমীন হাওলাদার সমকালকে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে কোনো সংগঠন, প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্মৃতি ট্রাস্টের অনুমতি নিতে হয়। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার সময় এ বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। বিষয়টি এখন তারা অবগত। এখন তারা স্কুলের নামটির অনুমোদনের জন্য ট্রাস্ট বরাবর আবেদন করবেন।

জানা গেছে, স্কুলটির প্রধান কার্যালয়ের ওই কক্ষটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কর্তৃক টার্মিনালে নিযুক্ত ম্যানেজারের মৌখিক অনুমতি নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন টার্মিনালের আগের রাজস্ব আদায়কারী আবদুল্লাহ ব্রাদার্সের জসিম উদ্দিন। চলতি মাসের শুরুর দিকে তিনি ওই কক্ষটি স্থায়ীভাবে ব্যবহারের জন্য স্কুল কমিটিকে অনুমতি দেন। এর পর কক্ষটির সামনের দেয়ালে স্কুলটির নাম লেখা হয়।

টার্মিনালে নিযুক্ত ডিএনসিসির সহকারী ব্যবস্থাপক তৌহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, কক্ষটি ডিএনসিসি থেকে স্কুলের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তারা বরাদ্দের জন্য মেয়রের কাছে আবেদন করতে পারে। মেয়র চাইলে কক্ষটি স্কুলের নামে বরাদ্দ দিতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, ওই কক্ষটি টার্মিনালের আগের রাজস্ব আদায়কারী 'আবদুল্লাহ ব্রাদার্স' তাদের অর্থে নির্মাণ করেছিলেন। তারা এখন নেই। তাই কক্ষটি ডিএনসিসির অধীনে আসবে। কক্ষটি ডিএনসিসির অধীনে আনার বিষয়ে বর্তমান ইজারাদার তার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তবে সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেবে- এ ব্যাপারে আলোচনা হয়নি।

গাবতলী বাস টার্মিনালের বর্তমান ইজারাদার রাফি ট্রেডার্সের মালিক শামীম খান সমকালকে বলেন, আগে কক্ষটির দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা ছিল না। সাবা হোটেলের পাশে ওই কক্ষটি টার্মিনালের আগের রাজস্ব আদায়কারীর অফিস ছিল। টার্মিনালে বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো স্কুল আছে- এটা আমি জানি না।

তবে তিনি বলেন, ওই কক্ষটির ওয়ালে তারা বঙ্গবন্ধুর নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম লেখে কীভাবে? তাদের নামে কোনো বরাদ্দ নেই। হঠাৎ যদি আগের রাজস্ব আদায়কারী জসিম উদ্দিন কক্ষটি কাউকে ব্যবহারের জন্য দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা অবৈধ হয়েছে। আর যদি কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে থাকে, সেটাও অবৈধ হয়েছে।

টার্মিনালের আগের রাজস্ব আদায়কারী জসিম উদ্দিন সমকালকে বলেন, কক্ষটি তিনি নিজের অর্থে নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে বসে টার্মিনালের রাজস্ব আদায় করা হতো। তার মেয়াদ শেষ হলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অসহায় ছিন্নমূল পথচারী স্কুলের পক্ষ থেকে কক্ষটি চাওয়া হয়। ওই স্কুলের পক্ষ থেকে দুপুরে ও রাতে ছিন্নমূল হতদরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে খাওয়ানো হয়। তারা সেবামূলক কাজ করছে- এসব বিবেচনা করে কক্ষটি তাদের দেওয়া হয়।

স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে ছোট্ট পরিসরে কিছু কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। শোক দিবস পালন পর্যন্ত স্কুলের নামটি রাখার জন্য সাইফুল ইসলাম ও কালু শেখকে অনুরোধ করেছিলাম। তারা আমাদের মানেননি। স্কুলের নামটি মুছে কক্ষটির দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছেন।