- রাজধানী
- পাসপোর্ট অফিসে অমানবিকতার শিকার এক চোখ অন্ধ নারী
পাসপোর্ট অফিসে অমানবিকতার শিকার এক চোখ অন্ধ নারী

ভুক্তভোগী তানিয়া নূর
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী তানিয়া নূর একটি চোখে কিছুই দেখতে পান না। এটা তার কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন বা ব্যক্তিগত সফলতায় কখনই দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়নি। এক চোখের অন্ধত্ব নিয়ে তাই তার আক্ষেপও ছিল না। কারণ এই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাংবাদিকতার পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করেছেন দেশি-বিদেশি নানা প্রতিষ্ঠানে।
বৃহস্পতিবার তার জন্য ছিল একটি অস্বাভাবিক দিন। তানিয়া জানান, তার এক চোখ অন্ধ, সেই সনদ দিয়ে তাকে ই-পাসপোর্টের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়েছে। চোখে দেখেন না, এটা নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে হেনস্থা ও বিদ্রুপেরও শিকার হতে হয়েছে তাকে।
ই-পাসপোর্টের আবেদন করে নির্ধারিত সময়ে গত বৃহস্পতিবার তিনি রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে ছবি, চোখের মণি ও আঙুলের ছাপ দিতে গিয়ে এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। এ ঘটনা তিনি সবিস্তারে লিখেছেন নিজের ফেসবুক ওয়ালে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু তানিয়াই নন, ই-পাসপোর্টের জন্য ছবি, চোখের মণি ও হাতের আঙুলের ছাপ দিতে গিয়ে বিভিন্ন সময়েই ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। নানা ভোগান্তি আর দৌড়ঝাঁপের পর তাদের চিকিৎসকের সনদ জুগিয়ে পেতে হয় স্বপ্নের ই-পাসপোর্ট। যেসব কারণে তাদের চিকিৎসকের সনদ দেখিয়ে পাসপোর্ট নিতে হচ্ছে, এর আগে এসব কারণ তাদের সফলতায় কখনই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
তানিয়া ফেসবুকে লিখেছেন, 'আমি যে নিজেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভাবছি না, সেটাই বিরাট বড় অপরাধ। অথচ আমি ঢাকা বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় তৃতীয় হয়েছি কোনো বাড়তি সুযোগ না পেয়েই। আমি লিখেছি, দুইটা যন্ত্র বাজাতে পেরেছি, সংগীতের সার্টিফিকেট কোর্স শেষ করেছি, সাংবাদিকতা করেছি- আজ পর্যন্ত অন্ধ হিসাবে কোনো সুবিধা নিইনি বা নিজের প্রতিবন্ধিত্বকে পুঁজি করে কোনো কাজ ফাঁকি দিইনি। দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আজও কাজ করছি, মাস্টার্স করছি, লিখছি, পড়ছি- সরকার আমাকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেন না- অথচ আমার অন্ধত্বের সার্টিফিকেট চান।'
ওই নারীর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ূব চৌধুরী সমকালকে বলেন, যারা ই-পাসপোর্ট পেতে চান তাদের দুই হাত, চোখের মণি এবং মুখমণ্ডল অক্ষত থাকা আবশ্যক। এরপরও মানবিক কারণেই তারা এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সনদ সার্ভারে সংরক্ষণ করে ই-পাসপোর্ট দিচ্ছেন।
মহাপরিচালক বলেন, ই-পাসপোর্টে হাতের ছাপ, চোখের মণি বা মুখমণ্ডলের ছবি না থাকলে তো পাসপোর্ট বাহক ঝামেলায় পড়বেন। সেক্ষেত্রে সার্ভারে এসবের চিকিৎসক সনদ থাকলে বাহক হয়রানিমুক্ত থাকবেন।
জমা দেওয়া চিকিৎসকের সনদ সঠিক কি-না বা নকল সনদ জমা দেওয়া হচ্ছে কি-না, তা যাচাইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারো জাল সনদের বিষয়টি প্রমাণিত হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এক চেখের অন্ধত্বের কারণে তানিয়াকে শুধু চিকিৎসকের সনদই দিতে হয়নি, পাসপোর্ট অফিসের কর্মীদের হাতে হেনস্থা হয়েছেন বলেও তিনি দাবি করেন। তানিয়া সমকালকে বলেন, তার এক চোখে দেখেন না, অন্ধ চোখে কাজল দিয়েছেন- এসব বিষয় তুলে পাসপোর্ট অফিসের অন্তত চারজন কর্মী তার সঙ্গে বিদ্রুপাত্মক আচরণ করেছেন। তারা রীতিমতো হেনস্থা করেছেন তাকে।
তিনি আরও বলেন, তার একটি চোখ অন্ধ হলেও আপাতদৃষ্টিতে সেটি স্বাভাবিকই দেখায়। এরপরও তাকে প্রথমেই শুনতে হয়েছে- 'আপনার অন্ধত্বের সার্টিফিকেট কই? আপনি যে দেখেন না, তা চোখ এমন স্বাভাবিক কেন? আর আপনি গোপন করলেন কেন? আপা আপনি চোখে কাজল দিয়ে আসছেন বলেই স্ক্যান করা যায় না- অন্ধ চোখ নরমাল দেখায় কেন? আপনি অন্ধ তার প্রমাণ কী? আপনার এটা কি নকল চোখ?'
ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, 'জীবনের এতো লম্বা যাত্রায় কোনো কাজ কখনো আমি এক চোখ দিয়ে কিছু কম পেরেছি বলে মনে হয়নি। আর নিজের বিস্মৃত প্রায় অন্ধত্ব নিয়ে সবসময় বলাটাও অপ্রাসঙ্গিক আর দুর্বলতা বলে আমি মনে করি। আজ বাংলাদেশ সরকারের নাগরিক হিসাবে ই-পাসপোর্ট করতে গিয়ে প্রথম জানতে পারলাম যে আমি অন্ধ এটার সার্টিফিকেট লাগে। ঢাক পিটিয়ে বলতে হবে প্রচার করতে হবে- ভাইসব আমি অন্ধ।'
তানিয়া আরও লিখেছেন, 'আমাকে ডক্টরের কাছ থেকে অন্ধত্বের প্রমাণ সংগ্রহ করে আনতে হয়েছে শেষমেশ। আর জীবনে এই প্রথম এই বিষয় নিয়ে চোখে জল গড়িয়েছে। যেদেশে প্রশাসনিক পর্যায়ে, সামান্য মানবিকতার, সভ্যতার আভাস নাই, সেই সিস্টেম নাকি আমার ট্যাক্সের টাকায় চলে?'
পাসপোর্ট অফিসের কর্মীদের মাধ্যমে হেনস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ূব চৌধুরী বলেন, সেবাপ্রত্যাশী নারীর ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তার নজরে এসেছে। তিনি এ নিয়ে তদন্তের ব্যবস্থা করছেন। অভিযোগকারী সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন