ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ওষুধের নামে কী খাচ্ছি, নিজেরাই জানি না

সাক্ষাৎকারে ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ

ওষুধের নামে কী খাচ্ছি, নিজেরাই জানি না

ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২১ | ১৪:১৭

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে ৬৮ শতাংশ ব্যয় করছে। সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় ওষুধের পেছনে। এরপরই পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অন্যান্য বিষয়ে অর্থ ব্যয় হয়। একইসঙ্গে সিংহভাগ মানুষ সরকারির পরিবর্তে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের কারণে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তবে যে ওষুধের পেছনে বেশি অর্থ ব্যয় হয়, সেটির মান নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ। তিনি সমকালকে বলেছেন, গুণগত মান যাচাই না করে বাজারজাত করার কারণে মানুষ কী ওষুধ খাচ্ছেন তা জানতে পারছে না। সেবা গ্রহণে ব্যক্তির ব্যয় বৃদ্ধিসহ স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক বিষয় নিয়ে সমকালের সঙ্গে তিনি গত মঙ্গলবার কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।

সমকাল: ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বংয়সম্পূর্ণ। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের প্রায় দেড়শর মতো দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশ, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়েও বাংলাদেশে ওষুধের দাম কম। অথচ স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ টাকা চলে যাচ্ছে ওষুধের পেছনে। ভারতে এ ব্যয় ২৮ শতাংশ। এর কারণ কী? এই ব্যয় কীভাবে কমানো যায়?

আবদুল হামিদ: এজন্য কয়েকটি কারণ দায়ী। তবে প্রধান দায়ী চিকিৎসকরা। উপঢৌকন, বিদেশ ভ্রমণসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সুবিধা পেয়ে ওষুধ কোম্পানির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে অধিকাংশ চিকিৎসক রোগীর ব্যবস্থাপত্রে প্রয়োজনীয় নয় এমন ওষুধ লেখেন। একজন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক কেন আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ওষুধ, ফুড স্যাপলিমেন্ট ব্যবস্থাপত্রে লেখেন তখন এটি প্রমাণ হয়। আবার কয়েক বছর ধরে বাজারে বিক্রির শীর্ষে রয়েছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের ফলে এ ওষুধটির ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ অসংক্রামক রোগ চিকিৎসায় ব্যবহূত প্রতিটি ওষুধই ব্যয়বহুল এবং অধিকাংশ ওষুধ সারাজীবন সেবন করে যেতে হয়। অথচ জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনলে ওষুধের প্রয়োজন হতো না। এভাবে ওষুধের পেছনে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আবার ওষুধের গুণগত মান সঠিক না থাকার কারণেও ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ওষুধের ব্যয় কমাতে হলে প্রথমে জেনেরিক নামে ওষুধ থাকতে হবে। তখন চিকিৎসকের কাছে নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেওয়া সম্ভব হবে না। এতে করে অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবহার কমে যাবে।

সমকাল: বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত ওষুধ অনেক দেশে রপ্তানি হচ্ছে। অথচ আপনি ওষুধের মান সঠিক না থাকার কথা বলেছেন। গুণগত মান ঠিক না থাকলে কীভাবে বিদেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে?

আবদুল হামিদ: মান নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন আছে। উন্নত দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে তৈরি ওষুধের মান কোন পর্যায়ে রয়েছে তা জানার জন্য 'বায়ো-ইকুইভ্যালেন্স টেস্ট' করে যাচাই করা হয়। মান খারাপ হলে সেটি বাজারজাত করা হয় না। কিন্তু দেশের বাজারে যেসব ওষুধ বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর ক্ষেত্রে এই টেস্ট করা হয় না। কারণ, দেশে ওষুধের মান যাচাইয়ের এই পরীক্ষা ব্যবস্থাটি নেই। কিন্তু রপ্তানি করা ওষুধের ক্ষেত্রে অন্য দেশ থেকে অবশ্যই 'বায়ো-ইকুইভ্যালেন্স টেস্ট' করতে হয়। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ কারণে রপ্তানি করা ওষুধের দামও বেশি পড়ে যায়। আর দেশে বাজারজাত করা ওষুধের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো যা তৈরি করে দেয় সেগুলো আমরা সেবন করি। সুতরাং ওষুধের নামে আমরা কী খাচ্ছি, তা নিজেরাই জানি না।

সমকাল: স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট কয়েক বছর আগে গবেষণা করে এটি দেখিয়েছে। এখন সরকারি গবেষণায়ও একই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতি বছরই বাজেটে বরাদ্দ বাড়ছে। অথচ ব্যক্তির ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী?

আবদুল হামিদ: মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন ও খাদ্যাভ্যাস এর পেছনে দায়ী। আগে শিক্ষার্থীরা হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতেন। মানুষ হেঁটে বাজারে যেতেন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে রাস্তাঘাট পাকা হওয়ায় মানুষ হাঁটাচলার পরিবর্তে যানবাহন ব্যবহার করছে। একইসঙ্গে আর্থিক অবস্থা উন্নতির কারণে খাদ্য তালিকায়ও পরিবর্তন এসেছে। অস্বাস্থ্যকর ও ভেজাল খাবার গ্রহণ বাড়ছে। ভেজাল খাবার গ্রহণ এবং হাঁটাচলা কমে যাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ, গ্যাস্ট্রিক, লিভার সিরোসিস, কিডনিসহ অসংক্রামক রোগগুলো অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির কারণে অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতাও বেড়েছে। এ কারণে মানুষ চিকিৎসা নিতে হাসপাতালমুখী হচ্ছে। সামর্থ্যবানরা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতে নিজের পকেট থেকে অধিক পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে এবং এটি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমাতে হবে। এ লক্ষ্যে দাতা সংস্থার পরামর্শ মেনে ২০১২ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ২০১২-৩২ সাল মেয়াদি একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছিল। এতে ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির স্বাস্থ্য ব্যয় কমে ২০৩২ সালে ৩২ টাকা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উল্টো ব্যয় বেড়েছে। তার মানে ওই কৌশলপত্র অনুযায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কার্যক্রম পরিচালনা করেনি কিংবা আমলে নেয়নি। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলায় কয়েক বছর আগে একটি পাইলট প্রকল্প শুরু হয়েছিল। সেটির অবস্থা জানা যায়নি। ধারণা করছি, ওই প্রকল্পটি সফল হয়নি। সুতরাং ব্যক্তির ব্যয় কমাতে হলে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

সমকাল: স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এটি স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধির একটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালমুখী কেন হচ্ছে না অথবা কী পরিবর্তন হলে মানুষ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন?

আবদুল হামিদ: দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালগুলোতে গত কয়েক বছরে তিন থেকে পাঁচ গুণ হারে শয্যা বাড়লেও জনবল বাড়েনি। একইসঙ্গে অর্ধেক কিংবা তারও বেশি পদ শূন্য পড়ে আছে। আবার পদায়নকৃতদের উপস্থিতিও অনিয়মিত। এতে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না। আবার রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে শয্যা পাওয়া দুস্কর। অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য যে পরিবেশ প্রয়োজন তা সরকারি হাসপাতালে নেই। এ কারণে সামর্থ্য আছে-এমন মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন। এতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অথচ রাজধানী ও বিভাগীয় পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ হাসপাতাল মানসম্পন্ন নয়। অথচ চিকিৎসা ব্যয় বেশি। এগুলোকে একটি নিয়মের মধ্যে এনে গ্রেডিং করে চিকিৎসা ব্যয় নির্ধারণে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে সরকারি হাসপাতালে শয্যার সঙ্গে মিল রেখে জনবল বৃদ্ধি, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করে মান উন্নয়নের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে মানুষ সরকারি হাসপাতালমুখী হবে। এভাবে চিকিৎসা ব্যয় কমে আসবে।

সমকাল: স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় কম। অথচ সেই কম বরাদ্দও ব্যয় হয় না। এই ব্যয় না করার পেছনে কোন কারণ দায়ী বলে আপনি মনে করেন? এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য করণীয় কী?

আবদুল হামিদ: চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা করা ও দক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশের স্বাস্থ্য খাত পরিচালিত হলেও বাংলাদেশে সেটি হচ্ছে না। নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ব্যক্তিরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত নন। আবার কাজটি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানলাভের আগেই অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যেতে হয়। এতে খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার যে চিকিৎসকরা হাসপাতালের পরিচালক কিংবা প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন তারাও ক্রয় সম্পর্কিত নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অবগত নন। এর ফলে কেউ প্রয়োজন হলেও দুর্নীতির ভয়ে কেনাকাটা করেন না। আবার কেউ কেউ কেনাকাটা করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এতেও বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না। সুতরাং চিকিৎসকের বিসিএস পরীক্ষার সময় প্রশাসন, শিক্ষক, ক্লিনিক্যাল এবং জনস্বাস্থ্য-এই চারটি বিষয়ে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে একটি দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে উঠবে।

সমকাল: স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির বিষয়টি আলোচিত। এই দুর্নীতিও কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করা হয়। দুর্নীতি প্রতিরোধে আপনার পরামর্শ জানতে চাই।

আবদুল হামিদ: এ ক্ষেত্রে একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয় করে এই কমিশন হবে। তারা স্বাস্থ্য খাতের সংশ্নিষ্টদের পরামর্শ দেবেন এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালিত হলে দুর্নীতি প্রতিরোধের পাশাপাশি জনবান্ধব স্বাস্থ্য খাত গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন

×