ছেলেটা আমার ভীষণ দুরন্ত, ডানপিটে, দস্যি, কতই না অনুযোগ ছিল মা  রাশেদা বেগমের ! পড়াশোনায় যত মনযোগ, তার চেয়েও বেশি আড্ডাবাজি আর ফুটবলে পড়ে থাকে ছোট্ট ছেলে দুর্জয়ের মন। এই ছেলের ভবিষ্যৎ কী! রাশেদা বেগমের চিন্তার যে অন্ত নেই। বড় ছেলেটির পড়াশোনা থমকে যাওয়ার পর ছোট ছেলে দুর্জয়কে ঘিরেই স্বপ্ন বুনছিলেন তিনি।

কিন্তু ২৯ নভেম্বর সোমবার রাতে রামপুরা কাঁচাবাজারে সড়ক পারাপার হওয়ার সময় ঘাতক বাস কেড়ে নেয় দুর্জয়ের প্রাণ। বাসের ধাক্কায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে সড়কে পড়ে থাকে দুর্জয়ের মৃতদেহ। রামপুরার তিতাস রোডের বাসা থেকে দৌঁড়ে ঘটনাস্থলে যান বাবা আবদুর রহমান। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দেহাবশেষ জড়িয়ে বসে থাকেন সড়কে। বিক্ষুব্ধ জনতা তখন সড়কে ১২টি বাস আটকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

সড়কজুড়ে দাউদাউ আগুনের মধ্যেই একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে সড়কে পড়ে থাকা দেহাবশেষ জড়ো করে নিয়ে চলল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।

সেই খবর তিতাস রোডে পৌঁছুতে মূর্ছা যান মা রাশেদা বেগম। ভাড়া বাসায় তালা ঝুলিয়ে সড়কে এসে বসেছিলেন রাতভর। ছেলে দুর্জয়কে না নিয়ে তিনি যে ঘরে ফিরবেন না। দুর্জয়ের বাকপ্রতিবন্ধী বোনকে সঙ্গে নিয়ে রাতভর তিতাস রোডে গণি মসজিদ গলিতে বসে রইলেন তিনি। 

বছর পনের আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরাইল থানার হালুয়াপাড়া থেকে ঢাকায় আসেন আবদুর রহমান ও রাশেদা দম্পতি। গণি মসজিদের ঠিক উল্টো দিকে একটি ছোট্ট টং দোকানে চা বিক্রি করেন আবদুর রহমান। মাইনউদ্দিন ইসলাম দুর্জয়ের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের ভরণপোষণ আসত এই দোকানের আয় থেকে। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার দোকানেও বসতেন তিনি।

মঙ্গলবার সকালে দুর্জয়দের বাসার গলিতে গেলেই দেখা মেলে মা রাশেদা বেগমের। সন্তানহারানো মায়ের আহাজারিতে তখন স্তব্ধ এলাকাবাসী। 

মা রাশেদা বেগম  বিলাপের সুরেই বলেন, ‘আমার ছেলেডা তো চইল্যা গেল। আমারে থুইয়া সে চইল্যা গেল।  আমার ছেলেডারে আইন্যা দিতে পারবা কেউ?’

দুর্জয়ের বড় ভাই পেশায় বাসচালক। তার স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। দুর্জয় মাকে কথা দিয়েছিলেন, পড়াশোনা শেষ করে তিনি ‘বড় ব্যবসায়ী’ হয়ে সংসারে অনটন ঘুচাবেন।

ছেলেকে হারিয়ে মা রাশেদা বেগমের বিলাপে  তিতাস রোডও শোকার্ত। ছবি-জয়ন্ত সাহা

দুপুর হলে বাবা ঘরে ফিরতে দেরি করতেন। তা মোটেও ভালো লাগত না দুর্জয়ের। দুর্জয় দোকানে গিয়ে বাবাকে জোর করে বাসায় পাঠাতেন। বলতেন, ‘আব্বা আপনি বাসায় যান তো, আমি আছি দোকানে। আপনে খাওয়াদাওয়া করে জিরায়ে আসেন। চিন্তা কইরেন না।’

বাবা আবদুর রহমানের চোখে এখন ভাসছে দুর্জয়ের সব বায়না, আবদার। স্বজনদের কোলে শুয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আমার ছেলেটা কি সত্যি আইবো না আর?’ স্বজন আর পড়শিরা তখন জবাব দেবেন কী? তখন সবার চোখে জল। 

ছেলে দুর্জয় আর ফিরবেন না, এ কথা মানতে নারাজ বাবা আবদুর রহমান। ছবি-জয়ন্ত সাহা

সবার চোখের অলক্ষ্যে বোন ঝুমা বসেছিলেন ঘরের এক কোণে। তার নিস্তব্ধতাই যেন বলে দিচ্ছিল সব শোকবার্তা।

মঙ্গলবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার হালুয়াপাড়া গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন রাশেদা বেগমের দস্যি ছেলে দুর্জয়।