সদা হাসিখুশি, প্রাণপ্রাচুরে্য ভরপুর মাঈনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয় ক’দিন আগে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছিলেন! হুট করেই তাকে পেয়ে বসে মৃত্যু-ভাবনা। 

মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে বন্ধুদের ভরপুর আড্ডা শেষে বন্ধু  নাজির, মাসুম আর সাব্বিকে তিনি বলেছেন, ‘দোস্ত যেকোনো দিনই কিন্তু আমরা মারা যেতে পারি, কেউ তা বলতে পারি না। তোরা সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করবি, ডাকবি। তিনি সবকিছুর মালিক।’

বন্ধু দুর্জয়ের জানাজা শেষে এ কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সাব্বির, যিনি রামপুরা একরামুন্নেসা স্কুলে দুর্জয়ের সহপাঠী ছিলেন।

সোমবার রাত ১০টার দিকে রাজধানীর রামপুরার কাঁচাবাজারের কাছে অনাবিল পরিবহন ও রাইদা পরিবহনের ওভারটেকিংয়ের সময় বাসচাপা পড়ে মারা যান মাঈনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়। দুর্জয় এ বছর রামপুরার একরামুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। স্কুলটির বাণিজ্য শাখার ছাত্র ছিলেন তিনি। 

দুর্জয়ের মৃত্যুর পর বিক্ষুব্ধ জনতা ডিআইটি রোডে ১২টি বাসে অগ্নিসংযোগ করে। রামপুরা, খিলগাঁও, বনশ্রী এলাকার বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার বেলা ১০টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে মঙ্গলবার দুপুরে দুর্জয়ের মরদেহ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।পরে বাদ আসর রামপুরার তিতাস রোডের গণি মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে মঙ্গলবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরাইল থানার হালুয়াপাড়া গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত হন দুর্জয়।

দুর্জয়ের জানাজায় অংশ নিতে আসা তার সহপাঠী নাজির হোসেন সমকালকে বলেন, ‘সদা হাসিখুশি, মজার একটা মানুষ ছিল আমাদের দুর্জয়। কখনও কাউকে হিংসা করত না। কারও মন খারাপ হলে সে মজায় মজায় মন ভালো করে দিতো। বন্ধুরা কেউ তাকে পাত্তা না দিলে, খোঁজ না নিলে বলত- কী রে দোস্ত ভুইল্যা গেসোস? ’

বন্ধু আবদুল্লাহ মাসুম বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার পর সিলেট যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম সবাই মিলে। কিন্তু সেটা হল না।’

পড়াশোনার পাশাপাশি দুর্জয়ের মন পড়ে থাকত ফুটবল মাঠে। আফতাবনগরে বন্ধুদের নিয়ে প্রতি বিকেলেই তিনি মেতে থাকতেন মাঠে। 

মাসুম বলেন, ‘দুর্জয় খুব ভালো স্ট্রাইকার হয়ে উঠতে চেয়েছিল।’

পরিবারের আর্থিক টানাপড়েনের কথা বন্ধুদের সঙ্গে বলতেন দুর্জয়। 

দুর্জয়ের বন্ধু সেলিম বলেন, ‘আমাদের কাছে সে বলত, তার পরিবারের কথা। সে পরিবারের হাল ধরতে চাইত। বাবার দোকানে গিয়ে বসত। সে আমারে বলছিল, বড় হয়া একদিন মস্ত বড় বিজনেসম্যান হবে। তারপর পরিবারের সব দুঃখকষ্ট সে একলা ঘুচাবে। কিন্তু দেখেন, সেই ই আর আমাদের মধ্যে নাই। একটা মানুষ কেমন কইরা হুট কইরা নাই হয়ে গেল।’

দুর্জয়ের জানাজা শেষে স্বজনরা যখন খাটিয়া তুলছেন অ্যাম্বুলেন্সে, তখন প্রিয় বন্ধুর কফিন ধরে সাব্বির, সেলিমদের গগনবিদারী আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। দুর্জয়ের খাটিয়া নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স যত দ্রুত ছুটে, তার চেয়েও দ্বিগুণ গতিতে মোটরসাইকেল ছুটিয়ে বন্ধুকে সঙ্গ দিলেন তারা। বন্ধু নেই এ কথা তারা মেনে নিতে চান না। 

‘ক্লাসে মনযোগী ছিল দুর্জয়’

দুর্জয়ের স্কুল রামপুরা একরামুন্নেসা হাই স্কুলটি দিনভর ছিল শোকস্তব্ধ। মঙ্গলবার সকালে বৈঠকে বসেছিলেন সব শিক্ষকরা।  

প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান হাওলাদার সমকালকে বলেন, ‘দুর্জয়ের মৃত্যুতে আমরা শোকার্ত। সব শিক্ষকরা মিলে বসেছিলাম আজ। আমরা একটা শোকবার্তা লিখে ব্যানার টানাব স্কুলের সামনে। স্কুলের শিক্ষার্থীরা তো উত্তেজিত ভীষণ। তাদেরও শান্ত রাখতে হচ্ছে। দুর্জয়ের বাসায় গিয়ে আমরা সবাই সান্তনা দিয়ে এসেছি। আসলে এই ঘটনার পর পরিবারকে কী বলে সান্তনা দেওয়া যায়, সেটা আমাদের জানা নেই।’

দুর্জয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দুর্জয় আমাদের স্কুলের বাণিজ্য বিভাগের গ শাখার ছাত্র ছিল। সে মাঝারি মানের ছাত্র হলেও পরীক্ষা, ক্লাসে নিয়মিত ছিল। তার মেধার স্বাক্ষর ছিল ক্লাসে। করোনার সময় বাসা থেকে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হত। সে কোনোদিন তাতে ফাঁকি দেয়নি বলে তার ক্লাস টিচার আমাকে জানিয়েছেন। সে শিক্ষকদের বলত, ভালো করে পড়াশোনা করে সে পরিবারের দুঃখ ঘুচাবে।’