- রাজধানী
- বায়ুদূষণে ঢাকা এখন রোগশোকের শহর
বায়ুদূষণে ঢাকা এখন রোগশোকের শহর

শীতল প্রকৃতি। রাতে ঝরছে শিশির। সকাল বেরিয়েই উঁকি দেয় ঝলমলে সূর্যের আলো। এমন আলোয় চারদিক স্বচ্ছ হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু ঢাকায় চারদিকে ধূলিকণা ভাসছে কুয়াশার মতো। বুকভরে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। শীতের শুরু থেকেই বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা প্রায়ই উঠে আসছে বিশ্বের শীর্ষে। গত বছরের তুলনায় এ বছর শীত মৌসুমে ঢাকায় বায়ুদূষণ বেড়েছে ১৯ শতাংশ। বাতাসের বিষে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। গবেষণায় উঠে এসেছে, নানা রকম দূষণে বাংলাদেশে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে এক লাখ ২৩ হাজার মানুষ।
এরপরও দূষণ ঠেকাতে সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দূষণ কমাতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনাও উপেক্ষিত। খসড়া তৈরির দুই বছরেও পাস হয়নি 'নির্মূল বায়ু আইন'।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঢাকায় দূষণ বাড়ার উপযোগী উপাদান দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে উন্নয়ন কর্মকা, ইটভাটা, বর্জ্য পোড়ানো, কলকারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়া দূষণের জন্য দায়ী। ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা বলছে, ঢাকায় বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, রোড ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮, যানবাহন ১০, বায়োমাস পোড়ানো ৮ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের গত বছরের এক জরিপ বলছে, বায়ুদূষণের জন্য অর্ধেক (৫০ শতাংশ) দায়ই তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া ধোঁয়ার। ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ, তুষের মতো জৈব বস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ণ বস্তুকণা। বাকি ১০ শতাংশ দূষিত বস্তুকণা আসে ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া থেকে।
বায়ুদূষণজনিত রোগে দেশে কতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। চিকিৎসকরা বলছেন, দূষণের জেরে শুধু ফুসফুসই নয়, ঝুঁকির মুখে পড়ছে নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত 'এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। দেশের বাতাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক পিএম ২.৫-এর পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা পরিমাণের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি।
বায়ুদূষণ কীভাবে ঢাকার মানুষের ওপর প্রভাব ফেলছে, তা ব্যাখ্যা করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, দূষিত বস্তুকণা ফুসফুস হয়ে রক্তেও চলে যায়। রক্তের মধ্যে গিয়ে লিভার, কিডনিসহ নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। হরমোনকেও প্রভাবিত করে। ফলে একদিকে শ্বাসতন্ত্রীয় অসুখ হচ্ছে, অন্যদিকে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ যেমন- নিউমোনিয়া, টিউবারকোলোসিস, গলায় ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে।
আবার মাথা ঝিমঝিম, মাথাব্যথা, বমিভাব তৈরি হয়। এর প্রভাবে হূৎপিে র গতি বেড়ে যায়। বায়ুদূষণ নারী-পুরুষের বন্ধ্যত্বের সমস্যা ছাড়াও বেশ কিছু জটিল সমস্যা তৈরি করছে।
স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে এক লাখ ২৩ হাজার মানুষ। ভারত ও চীনে মারা যাচ্ছে ১২ লাখ মানুষ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মানুষ দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে এলে তা নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহের ভেতরে ও রক্তে প্রবেশ করে। এতে মস্তিস্কে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় ও স্নায়ুগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। অনেকের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কোনো কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। অনেকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করেন।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ২০২০ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভিভাবকরা যত শিশুকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান, তাদের ৪৯ শতাংশ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। বর্ষা মৌসুমে শ্বাসকষ্টে ভোগা শিশুদের হার ৩৫ শতাংশে নেমে আসে।
শিশু হাসপাতালের পরিচালক সৈয়দ সফি আহমেদ বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মা বায়ুদূষণের শিকার হলে সন্তান আকারে ছোট হতে পারে, ওজন কম হতে পারে, মানসিক ও স্নায়ুগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। অটিস্টিক শিশু জন্ম হওয়ার একটি কারণ বায়ুদূষণ।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুম লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার সমকালকে বলেন, বায়ুদূষণের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে তারা কোনো গবেষণা করছে না। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বায়ুদূষণ।
তিনি বলেন, করোনায় ২০ মাসে ২৮ হাজার মৃত্যু হলেও বায়ুদূষণজনিত রোগে বছরেই এক লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা যায়। বায়ুদূষণজনিত রোগে বছরে আক্রান্ত হয় প্রায় ২০ লাখ মানুষ। স্বাস্থ্য বিভাগ কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও বায়ুদূষণ নিয়ে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই।
জারি হয় না স্বাস্থ্য সতর্ককতা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইপিএর হিসাবে, কোনো একটি শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০ হলে তাকে অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। এটি নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়, একে স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ তা জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকা মানে ওই স্থানের বায়ু 'বিপজ্জনক'। ঢাকার বায়ুমান বছরের পাঁচ মাস অস্বাস্থ্যকর থেকে বিপজ্জনক থাকে।
একিউআই সূচক পর্যবেক্ষণ করে ক্যাপস জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর শীত মৌসুমে ঢাকায় বায়ুদূষণ বেড়েছে ১৯ ভাগ। গত ডিসেম্বরে ছয় দিন ঢাকায় বায়ুর মান বিপজ্জনক ছিল। এ দিনগুলোতে টানা ২-২৩ ঘণ্টা বায়ুর মান ৩০০ থেকে ৪৪৯-এ ওঠে। জানুয়ারির ২১ দিনের মধ্যে ১১ দিন ঢাকার বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর, তিন দিন বিপজ্জনক এবং সাত দিন অস্বাস্থ্যকর ছিল।
বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল অনুযায়ী, জানুয়ারিতে বিশ্বের ১০০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান শীর্ষে ছিল আট দিন। আর চলতি মাসের ২০ দিনের মধ্যে ১১ দিনই ঢাকা বায়ুদূষণের তালিকায় এক নম্বরে ছিল। গত মঙ্গলবার থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত টানা চার দিন ঢাকা ছিল এক নম্বরে। গতকাল ছুটির দিনেও ঢাকার বায়ু বিপজ্জনক ছিল। সকাল থেকে একিউআই স্কোর বাড়তে বাড়তে ৩৭২-এ গিয়ে ঠেকে।
এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাব বলছে, এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশ জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বায়ুদূষণের মাত্রা ৩০০-এর ওপরে উঠলে স্বাস্থ্য সতর্কতা জারির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ঢাকার বায়ুর মান খারাপ হলেও কখনোই সতর্কতা জারি করা হয়নি।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, সংসদীয় কমিটি এ নিয়ে সুপারিশ করেছিল। সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এটা দুঃখজনক।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, বায়ু বিপজ্জনক বা অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে থাকলে আবহাওয়া অধিদপ্তর বা পরিবেশ অধিদপ্তরের উচিত সতর্কতা সংকেত দেওয়া, যাতে মানুষ খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাইরে না যায়। গেলেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যেন মাস্ক পরে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বরাদ্দ না থাকায় বায়ুদূষণ নিয়ে কোনো কার্যক্রম নেই।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন দাবি করেন, দূষণ কমাতে আমরা ব্যাপক কাজ করছি। গত দেড় বছরে অবৈধ ইটভাটাগুলোর ৬২ শতাংশ বন্ধ করা গেছে।
তিনি বলেন, চলতি মাস থেকে সারাদেশে বায়ুদূষণের বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মশালা হচ্ছে। স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি এবং জনগণকে বায়ুদূষণ থেকে মুক্ত করতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত আসবে।
মন্তব্য করুন