ঢাকার অপরাধ জগৎ দীর্ঘদিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সুমন শিকদার মুসা। আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার সমন্বয়কারী হিসেবে আবার তার নাম সামনে এলো। এই কিলিং মিশনে শুটার ভাড়া করে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল সরবরাহ করেন তিনি। এর আগে ২০১৬ সালে মতিঝিলে যুবলীগ কর্মী রিজভী হাসান ওরফে 'বোঁচা বাবু' হত্যার সময়ও শুটারকে ভাড়ার দায়িত্ব পড়েছিল তার ওপর। বাবু হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি। বিচার চলাকালে আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে করোনার সনদ দাখিল করে ১২ মার্চ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দুবাই পালিয়েছেন। পালানোর আগে ১০ বছর মেয়াদি নতুন পাসপোর্টও করেন এই টপ টেরর। তার আগে টিপু হত্যার সব ছক চূড়ান্ত করেন। বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসীদের তালিকায় নতুন করে মুসার নাম যুক্ত হলো।

রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক টিপু হত্যা মামলার তদন্তে নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। তিনটি গ্রুপের 'কমন টার্গেট' ছিলেন টিপু। হত্যা মিশন সফল করতে বিদেশে পলাতক অন্তত তিনজন শীর্ষ সন্ত্রাসী তাকে সরাতে 'সবুজ সংকেত' দেন। দেশে অবস্থানরত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের তারা ব্যবহার করেন। এর সঙ্গে মতিঝিল ও শাহজাহানপুরের স্থানীয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও রয়েছে। এই হিসাবের কারণেই টিপু হত্যা মিশনে যুক্ত হন ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক। তিনি যুবলীগ কর্মী 'বোঁচা বাবু' হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। ২০১৬ সালে বাবু খুন হন। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে (মতিঝিল ও শাহজাহানপুর) থেকে কে সরকার দলীয় মনোনয়ন পেতে পারেন এই পথ পরিস্কার করতে কোনো হিসাব আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে জানান, টিপুকে খুন করতে শুটার হিসেবে মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও শামীমকে ভাড়া করা হয়। মূলত আকাশ ও শামীম দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিলিং মিশন সম্পন্ন করার সময় শামীমের মোটরসাইকেলের পেছনে ছিলেন আকাশ। এরই মধ্যে আকাশ গ্রেপ্তার হলেও শামীম এখনও পলাতক। তিনি কোরআনে হাফেজ। তবে মতিঝিলকেন্দ্রিক আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে তার যোগসূত্র দীর্ঘ দিনের।

জানা গেছে, টিপুকে হত্যার ছক চূড়ান্ত করার পর ঢাকায় যে পরিকল্পনা বৈঠক হয়, সেখানে মুসা, শামীম, মোল্লা, মানিক, দামালসহ ৬-৭ জন ছিলেন। বৈঠকের বিষয়টি শুটার জানতেন। কার কী দায়িত্ব, তা ভাগ করে দেন মুসা। শুটারের কাছে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল সরবরাহ করেন তিনি।

এ ঘটনার ছায়াতদন্ত করেছেন এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ওমর ফারুকের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল, ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনীতি ছেড়ে শাহজাহানপুর থানা আওয়ামী লীগের নেতা হবেন। ওই থানার সাধারণ সম্পাদক হতে নানা সময় দৌড়ঝাঁপ করেন। তবে তিনি মনে করতেন, টিপু তার পথের কাঁটা। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, টিপু বেঁচে থাকা পর্যন্ত থানা পর্যায়ের নেতা হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে সোয়া দুই কোটি টাকার একটি ঠিকাদারি কাজ পান ফারুক। সেটি ১৬ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। ওই টাকা থেকে ৯ লাখ টাকা টিপুর কিলিং মিশনের সমন্বয়কারী মুসার হাতে দুই দফায় তুলে দেন।

আরেকজন কর্মকর্তা জানান, বাবু হত্যা মামলা দ্রুত বিচার আদালতে চলে যাওয়ার পর কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হন অভিযুক্ত ফারুক, নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, আবু সালেহ শিকদার ও মুসা। এজিবি কলোনিতে ফারুকের দুটি দোকান রয়েছে। অভিযোগ থেকে বাঁচানোর বিনিময়ে দোকান দুটি বাবুর বাবা কালামের নামে লিখে দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। এরপর কালাম বিষয়টি জানান তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু টিপুকে। ফারুকের প্রস্তাবে কোনো ধরনের সাড়া না দিতে কালামকে পরামর্শ দেন টিপু। এটি জানার পরও টিপুর ওপর মনে মনে ক্ষুব্ধ হন ফারুক।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, সাবেক যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও খালেদের মতো যারা মতিঝিল ও শাহজাহানপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন, তারা সব কাজ থেকে একটি ভাগ বিদেশে পলাতক আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের দিতেন। ক্যাসিনোকাণ্ডে সম্রাট ও খালেদ কারাগারে যাওয়ার পর টিপু তাদের অনুসরণ করে আন্ডারওয়ার্ল্ডকে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। হত্যা মিশনের কয়েক দিন আগেও শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান, মানিক ও বিকাশ ফোন করে বাবু হত্যার ব্যাপারে সমঝোতা করার চাপ দেন টিপুকে। এ ছাড়া তারা মতিঝিল আইডিয়াল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তিতে 'তাদের কোটা' দাবি করেন। তবে ওই প্রস্তাবে সাড়া দেননি টিপু। এ ছাড়া ২০০৮ সালে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাওছার খুন হন। শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিক ওই মামলার এক নম্বর আসামি। তিনি শুরু থেকেই বিশ্বাস করে আসছেন, টিপুর কারণে ওই মামলায় তিনি আসামি হয়েছেন।

জানা গেছে, মিল্ক্কী হত্যা মামলার চার্জশিট থেকে টিপু রেহাই পাওয়ার পর ২০১৬ সালে বাবুকে হত্যা করা হয়। মতিঝিলকেন্দ্রিক আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা শুরুতে ওই হত্যায় টিপুকে জড়াতে বাবুর বাবা কালামকে চাপ দেন। তবে কালাম উল্টো টিপুর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ওই হত্যাকাণ্ডের শুটার অমিতকে ভাড়া করেছিলেন মুসা।

ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, একাধিক মামলা মাথার ওপর থাকলেও আগে থেকে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা না থাকলে বিমানবন্দরে কাউকে আটকানো যায় না। ইমিগ্রেশনের তথ্য বলছে, ভ্রমণ ভিসায় বৈধ পথেই দেশ ছেড়েছেন তিনি। দুবাই বসে টিপু হত্যার সর্বশেষ দিকনির্দেশনা দেন মুসা। মুসার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। তার জন্ম ১৯৭৯ সালে। একসময় ফার্স্ট ভিডিশনে ফুটবল খেলতেন। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তার নামে ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে। পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হবে ২০৩১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। গোয়েন্দারা বলছেন, দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা থেকেই নতুন পাসপোর্ট তৈরি করেন মুসা। এক সময় তার পরিচিতি ছিল মিরপুর ও পল্লবীকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী হিসেবে। তবে ধীরে ধীরে পুরো ঢাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে পল্লবী এলাকার ডিশ, ময়লা, অবৈধ পানি, গ্যাস লাইনের ব্যবসার নাটাই মুসার হাতে। মুসার প্রতিনিধি হয়ে এই কারবার দেখভাল করছেন তার ভাগ্নে ইমরান।

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অপরাধ জগতের তথ্য রাখেন এমন একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জানান, টিপু হত্যা মিশনে মুসা ছাড়াও তার আপন ভাই আবু সালেহ শিকদার জড়িত। বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে দুই ভাই অপরাধ জগতে পা রাখেন। আশির দশকে মিরপুরে মুসার বাবা আবু সাইদ শিকদারকে হত্যা করা হয়। প্রায় দুই দশক পর মুসা ও তার ভাই সালেহ ওই হত্যায় অভিযুক্ত খোকনকে খুন করে। এরপর থেকে দুই ভাই পলাতক। তখনই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়। মুসার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলাসহ ১০টি মামলা আছে। তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা আছে ৮টি।