ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের ঢল উপচে পড়েছে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে। প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ঈদ আনন্দ উপভোগ করবেন বলে টিকিট যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। 

নির্বিঘ্নে টিকিট পেতে ঘরমুখো মানুষ শুক্রবার রাত থেকেই অবস্থান করছিলেন কমলাপুর রেলস্টেশনে।কিন্তু টিকিট বিক্রি শুরুর পর দেখা গেল নানা জটিলতা। কাউন্টার থেকে বলা হচ্ছে সার্ভার জটিলতা, নয়ত আসন স্বল্পতার কথা। 

একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে চারটি টিকিট দেওয়ার কথা থাকলেও কখনও কখনও সেটা পেতেও বেগ পেতে হচ্ছিল বলে জানালেন টিকিট কাটতে আসা মানুষ।

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে শনিবার (২৩ এপ্রিল) সকালে। কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেতে রাত থেকেই অনেকে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। 

তবে কাউন্টারের পাশাপাশি রেলওয়ে অনলাইনেও ৫০ শতাংশ টিকিট রেখেছে। তাই 'সুযোগ' হাতছাড়া না করতে লাইনে দাঁড়িয়েও অনলাইনে টিকিট কাটকে ঢুঁ মারছেন অনেকে।

শনিবার সকাল ৮টার কিছু সময় পর কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকিট বিক্রি শুরু হয়। এ সময় অনেকের হাতে থাকা মোবাইল স্ক্রিনে রেলওয়ের ই-টিকিট ওয়েবসাইট ব্রাউজ করতে দেখা যায়।

উপচে পড়া ভিড়ে দীর্ঘ অপেক্ষার পর টিকিট পেয়ে অধিকাংশের মুখে ছিল হাসি। তবে কয়েকটি পথে চাহিদা অনুযায়ী ট্রেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) কোচের টিকিট পাননি বলে অভিযোগ করেন টিকিটপ্রত্যাশীরা। 

টিকিট বিক্রিতে ধীরগতির জন্য কিছুক্ষণ পরপর টিকিটের সারিতে হইচই ও হর্ষধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। যেমন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের টিকিট শেষ হয়ে যায়। তখন সারিতে থাকা অপেক্ষমাণ লোকজন টিকিটের জন্য চিৎকার শুরু করেন।

কমলাপুর ছাড়াও রাজধানীর আরও ৪টি স্টেশনে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে টিকিট। শুধুমাত্র কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে টিকিট কেনার চাপ কমাতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে।

রাজশাহীগামী ধুমকেতু ট্রেনের টিকিট কাউন্টারের লাইনের সিরিয়ালে ৯৩ জনের পেছনে অপেক্ষা করছিলেন মনছুর আহমেদ নামের। 

বেসরকারি চাকরিজীবী এই ব্যক্তি বলেন, সেহেরির পরেই এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। যেহেতু পরিবারের সদস্য ও শিশুদের নিয়ে রাজশাহী যাব, তাই আমার এসি টিকিট প্রয়োজন। যত জনের পেছনে আমার সিরিয়াল সে অনুযায়ী এসি টিকিট পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই ৮টা বাজার পর থেকেই লাইনে দাঁড়ানো অবস্থাতেই অনলাইনে টিকিট কাটার চেষ্টা করছি মোবাইলে।

রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিটের লাইনে দাঁড়ানো তোফাজ্জল হোসেনও মোবাইলে চেষ্টা করে যাচ্ছেন অনলাইনে টিকিট কাটার। 

তিনি বলেন, লাইনে দাঁড়ালেও এসি টিকিট পাওয়ার আশায় অনলাইনে ননস্টপ চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে সার্ভার ডাউনের কারণে ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারছি না। যদি কোনোভাবে অনলাইনে টিকিট পেয়ে যাই তখন টিকিটের লাইন ছেড়ে চলে যাব। 

এখানে বেশিরভাগ লোকই লাইনে দাঁড়ানোর পরও ভালো টিকিটের প্রত্যাশায় অনলাইনে চেষ্টা করছেন। একটু খেয়াল করলে দেখতে পাবেন সবার হাতে মোবাইল, সবাই চেষ্টা করছেন, বলেন এ টিকিটপ্রত্যাশী।

কাউন্টার থেকে টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা রাকিবুল ইসলাম বলেন, যাত্রীরা যারাই আসছেন টিকিট থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সবাইকে  দেওয়া হবে। অনেকে লাইনে দাঁড়িয়েও অনলাইনে চেষ্টা করছেন। যে কারণে সার্ভারে সমস্যা হচ্ছে। তাই যাত্রীরা অনলাইনে ঢুকে টিকিট কাটতে পারছেন না।

রামপুরা থেকে এসেছেন চাকরিজীবী কাওসার আহমেদ। তিনি যাবেন রংপুর। নীলসাগর এক্সপ্রেসের দুটি এসির টিকিট কিনবেন তিনি। স্টেশনে এসেছেন ভোর চারটায়। 

কাওসার বলেন, ‘এসির টিকিট তো আসলে কাউন্টারেও পাওয়া যায় না, অনলাইনেও পাওয়া যায় না। গতকাল অনলাইনে চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। আজ এ জন্য কাউন্টারে টিকিট নিতে এসেছি, কিন্তু এসির টিকিট পাইনি। টিকিটের অর্ধেক অনলাইনে, অর্ধেক কাউন্টারে। কাউন্টারে প্রথম ১০ থেকে ১২ জনের পরই বলে এসির টিকিট শেষ। ১৫ মিনিটের ব্যবধানে এত এসির টিকিট গেল কই। এত টিকিট কাটল কে?’

গতকাল রাত তিনটায় ফার্মগেট থেকে কমলাপুর স্টেশনে এসে টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়েছেন সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আরেফীন। 

তার অভিযোগ, এসির টিকিট তিনি কাউন্টারেও পাননি, অনলাইনেও পাননি। বললেন, ‘সাহ্রি খেয়ে স্টেশনে এসেছি। সকাল আটটায় অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরু হয়। সার্ভারে লগইন করেছি তখন। কিন্তু সার্ভারে প্রবেশ করতে লেগেছে ২৬ মিনিট। সার্ভারে ঢুকে দেখি টিকিট বিক্রি ততক্ষণে শেষ।এভাবে অনলাইনে টিকিট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। নীলসাগর এক্সপ্রেসের দুটি এসির টিকিট দরকার ছিল। এখন শোভন চেয়ার টিকিট কিনে ফেরত যেতে হচ্ছে।’

এ বিষয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাসুদ সরোয়ার বলেন, ‘আমরা জেনেছি অনলাইনে অনেকে টিকিট কাটতে পারছেন না। এ বিষয়ে সহজ ডটকম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, সবাই যখন সকাল আটটায় টিকিটের জন্য একসঙ্গে সার্ভারে লগইন করে, তখন সার্ভারে সাইবার জ্যাম হচ্ছে। এ কারণে সকাল ১০টা ১০ মিনিট নাগাদ টিকিট পেতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।’

মোহাম্মদ মাসুদ সরোয়ার আরও বলেন, ‘টিকিট কাটার সময় জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখা হচ্ছে, যাতে টিকিটটা বাইরে বা কোনো কালোবাজারির হাতে না যায়। এ ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট। টিকিট অন্য কোথাও পাওয়ার সুযোগ নেই।’

প্রতিবার ঈদ এলে স্টেশনে টিকিট কাটতে ভিড় হয়, টিকিট কাউন্টারের সংখ্যা কেন বাড়ানো হয় না—এমন প্রশ্নের জবাবে স্টেশন ব্যবস্থাপক বলেন, টিকিট কাউন্টারের সংখ্যা পর্যাপ্ত। একটা টিকিটের বিপরীতে কখনো ৭০০ মানুষের চাহিদা। আগে কমলাপুর থেকে সব ট্রেনের টিকিট বিক্রি হতো। এবার সেটি ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার অন্য আরও চারটি স্থান থেকে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। তবু স্টেশনে মানুষের চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

মাসুদ সরোয়ার বলেন, ‘কোনো কোনো পথের ট্রেনে টিকিট ৭০০। এর মধ্যে কাউন্টারে ৩৫০ টিকিট। কিন্তু মানুষ টিকিটের সারিতে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার। এত চাপ নেওয়া কঠিন। যেহেতু আসনসংখ্যা সীমিত, তাই সীমিতসংখ্যক যাত্রীকে টিকিট দিতে পারব।’

কাউন্টারে টিকিট কেনায় ধীরগতি প্রসঙ্গে স্টেশন ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাসুদ সারোয়ার বলেন, মানুষ টিকিট পাওয়ার জন্য ভোর রাতে বা রাতে এসে দাঁড়িয়েছে। এনআইডি নম্বর নেওয়া হচ্ছে। টিকিট কাটতে গিয়ে একজন যাত্রী অনেক অপশনে সময় নিচ্ছে ফলে দেরি হচ্ছে।

যাত্রার সময় যাত্রীর জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করা হবে কি না, জানতে চাইলে স্টেশন ব্যবস্থাপক মাসুদ সারোয়ার বলেন, স্টেশনের কর্মকর্তারা, ট্রেনের টিকিট এক্সামিনাররা এটা নিশ্চিত করবেন। যে এনআইডি দিয়ে টিকিট কেনা হয়েছে, যাত্রীর সঙ্গে সে এনআইডি থাকতে হবে। ভ্রমণের সময় যাত্রীকে এনআইডির কপি রাখতে হবে।

কমলাপুর স্টেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কমলাপুর স্টেশনে সমগ্র পশ্চিমাঞ্চল ও খুলনাগামী ট্রেনের টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। 

ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীগামী আন্তনগর ট্রেনের টিকিট এবং তেজগাঁও স্টেশনে ময়মনসিংহ, জামালপুরগামী, দেওয়ানগঞ্জ স্পেশালসহ ওই অঞ্চলের সব আন্তনগর ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে মোহনগঞ্জ ও হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনের এবং ফুলবাড়িয়া পুরোনো রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেট ও কিশোরগঞ্জগামী আন্তনগর ট্রেনের টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২৭ এপ্রিলের টিকিট দেওয়া হচ্ছে আজ (২৩ এপ্রিল)। একইভাবে ২৮ এপ্রিলের টিকিট পাওয়া যাবে ২৪ এপ্রিল (রোববার), ২৯ এপ্রিলের টিকিট ২৫ এপ্রিল (সোমবার), ৩০ এপ্রিলের টিকিট ২৬ এপ্রিল (মঙ্গলবার) এবং ১ মের টিকিট ২৭ এপ্রিল (বুধবার) বিক্রি করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

এবার ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ এই স্লোগান বাস্তবায়নে যাত্রীদের এনআইডি-জন্ম সনদ ফটোকপি কাউন্টারে প্রদর্শন করে টিকিট ক্রয় করতে হবে। এনআইডি ছাড়া অন্য কোনো পরিচয়পত্র দিয়ে ট্রেনের টিকিট কাটা যাবে না।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৫ এপ্রিল থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত কোনো আন্তঃনগর ট্রেনের সাপ্তাহিক বন্ধ থাকবে না এবং ঈদের পরে যথারীতি তা কার্যকর করা হবে। সাপ্তাহিক বন্ধ বাতিলের ফলে অতিরিক্ত ৯২টি আন্তঃনগর ট্রেন বিশেষ ট্রিপে পরিচালিত হবে।

ঈদযাত্রা শেষে ট্রেনের ফিরতি টিকিট বিক্রি শুরু হবে আগামী ১ মে থেকে।