একটি মাঠ বাঁচাতে হাজার শিশুর অশ্রুধারা, প্রতিবাদমুখর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেয়াল, সংক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ। রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ হবে কার? এই প্রশ্ন এখন সবার। মাঠটি খেলার জন্য উন্মুক্ত থাকবে, নাকি থানার জন্য উঠবে ভবন। কয়েক দিনের এই বিবাদ গতকাল বুধবার নেয় নতুন মোড়। সকাল গড়িয়ে দুপুর, একে একে মাঠে জড়ো হতে থাকেন স্থানীয়রা। কারও হাতে গাছ, কারও হাতে ক্রিকেট ব্যাট-বল। একদিকে পুলিশি পাহারা, আরেকদিকে থানা ভবনের নির্মাণসামগ্রী পাশে রেখে খেলায় মাতে শিশু-কিশোররা। তবু থেমে নেই দেয়াল নির্মাণের কাজ। সিমেন্টের ওপর বসছে ইটের পর ইট। সমানতালে চলছে প্রতিবাদী স্লোগানও।
প্রতিবাদ জানাতে গতকাল দুপুরে ওই মাঠে আসে নাগরিক সমাজের একটি দল। মাঠের চারপাশে একে একে রোপণ করে ১৪টি ফলদ ও ঔষধি গাছ। ততক্ষণে পুরো মাঠ স্লোগানমুখর। পিছু হটে পুলিশ, সাময়িক বন্ধ হয়ে যায় দেয়াল নির্মাণকাজ। এর মধ্যে খবর আসে মাঠ ফিরিয়ে দিতে নমনীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠকে বসেছেন আন্দোলকারীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে।

অর্ধশতাব্দী ধরে যে মাঠে প্রজন্মের পর প্রজন্ম খেলে বেড়ে উঠেছে, সেই মাঠ ফিরে পেতে প্রতিবাদে শামিল হন আটককাণ্ডের সেই সৈয়দা রত্নাসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। আন্দোলনে হাতে হাত রাখেন পরিবেশকর্মী, সংস্কৃতিকর্মীসহ অগণিত মানুষ। এত এত মানুষকে পাশে পেয়ে শিশুরাও হারিয়ে যায় পুরোনো স্মৃতিতে। ব্যাট-বল হাতে মেতে ওঠে ক্রিকেট খেলায়। পড়ন্ত বিকেলে মাঠে পাশের দেয়ালে লেখা হয়, 'তেঁতুলতলা মাঠে শিশুরা খেলবে, থানা নয়'। টানিয়ে দেওয়া হয় নতুন সাইনবোর্ড। তবুও শঙ্কা কাটে না। খেলতে আসা কয়েকজন শিশুর আকুতিভরা কণ্ঠ, 'আমাদের মাঠে আমরা খেলতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, মাঠটি ফিরিয়ে দিন।'
প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, তেঁতুলতলা কখনও মাঠ ছিল না, এটা পরিত্যক্ত সম্পত্তি ছিল, সেজন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে থানা নির্মাণের। এখন বিকল্প জায়গা পেলে অন্য স্থানে থানা করার বিষয় বিবেচনা করা হবে। তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, তেঁতুলতলা মাঠ কখনোই পুলিশের ছিল না, এখনও নেই। মাঠ ফিরে পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা আসে গতকালের কর্মসূচি থেকে। দু'পক্ষের অনড় অবস্থানে স্থানীয়দের শঙ্কা, মাঠ সংকটের এ নগরীতে মানুষের প্রতিবাদ জয়ী হবে, নাকি আরও একটি প্রজন্ম হারিয়ে যাবে সবুজের ছোঁয়া থেকে।

আইন মেনে মাঠ বরাদ্দ নেয়নি পুলিশ :স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ১৯৮০ সালে তেঁতুলতলা মাঠকে এলাকার শিশু-কিশোরদের জন্য ব্যবহারের উপযুক্ত করার জন্য সরকারের কাছে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন অনুরোধ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরই ডেপুটি চিফ আর্কিটেক্ট মো. মতিন স্থানটি পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেন। ওই প্রতিবেদনের পর তেঁতুলতলার খালি জায়গাটিকে শিশুদের খেলার মাঠ হিসেবে তৈরির জন্য সব রকম ব্যবস্থা নিতে পূর্ত মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ডিটেল এরিয়া প্ল্যানে চূড়ান্ত খসড়ার গেজেটের ম্যাপে পরিস্কার করে 'তেঁতুলতলা মাঠ' নামে জায়গাটিকে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। কোনো অভিযোগ থাকলে গণশুনানির মাধ্যমে এটিকে পরিবর্তনের জন্য ডিটেল এরিয়া প্ল্যানের চূড়ান্ত খসড়ার পর ৬০ থেকে ৬৫টি দিন সময় দেওয়া হয়। সে সময় পুলিশ বিভাগ এ বিষয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি।

মোবাশ্বের হোসেন আরও বলেন, নগর উন্নয়ন কমিটি অসম্ভব শক্তিশালী কমিটি। প্রধানমন্ত্রীও যদি একটি মাঠ অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করতে চান, তাহলে সেটি পর্যালোচনা করার জন্য এ নগর উন্নয়ন কমিটির কাছে আসে। তাদের মত ছাড়া মাঠ অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আমি নিজেও ওই কমিটির সদস্য। পুলিশ এ কমিটি থেকে কোনো ছাড়পত্র নেয়নি। উন্মুক্ত জলাশয় ও মাঠ রক্ষায় আইন আছে, সেই আইনও লঙ্ঘন হয়েছে।
তবে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ঢাকার জেলা প্রশাসক জেনেবুঝে এ জায়গাটি পুলিশকে দিয়েছেন। জমির দাম হিসেবে টাকাও দিয়েছে পুলিশ। মন্ত্রী বলেন, আমি বিকল্প জায়গা খুঁজতে বলেছি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করব। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান বের হবে।

আশা দেখছেন আন্দোলনকারীরা :গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা একটি জায়গা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি দেব। মন্ত্রী জানিয়েছেন- সেই চিঠি তিনি পৌঁছে দেবেন। মন্ত্রী আমাদের হতাশ করেননি। আমরা কিছুটা আশা পাচ্ছি।
মাঠ রক্ষায় প্রয়োজনে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি :গতকাল বিকেলে তেঁতুলতলা মাঠে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে মাঠ শিশু-কিশোরদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার, পরিবেশ আন্দোলন ও সাংস্কৃতিককর্মীরা। অন্যথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঘেরাওসহ কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তারা।

এ সময় মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, আমরা স্পষ্ট বলছি, তেঁতুলতলা মাঠে যে নির্মাণকাজ চলছে, দ্রুততম সময়ে তা বন্ধ করা হোক। ঈদের জামাত ওখানেই হোক, যেটা সব সময় হয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কোথাও জায়গা না পেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বাড়িতে কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেন।

প্রতিবাদ সমাবেশে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ঢাকা শহরে আমরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে যাওয়ার অবস্থায় আছি। সেখানে যদি মাঠ দখল হয়ে যায়, তাহলে এ এলাকার নতুন প্রজন্ম কোথায় যাবে? তারা (পুলিশ) বলেছে, ভবন নির্মাণে রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে, তবে রাজউক বলছে জানে না। তাহলে কীভাবে এখানে থানা ভবন নির্মাণ হয়?

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার বলেন, প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঘেরাও করা হবে।
ব্যাট-বল হাতে সৈয়দা রত্না :'মাঠ নিয়ে আন্দোলন করব না ' মুচলেকা দেওয়া সেই প্রতিবাদী সৈয়দা রত্নাও ছেলেকে নিয়ে মাঠে আসেন। দুপর থেকে তিনি মাঠে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, দেয়াল লিখন ও সাইনবোর্ড টানানো কর্মসূচিতে অংশ নেন। এরপর কিছুক্ষণ সেই মাঠে ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলেন। 'আমাদের মাঠে আমরাই খেলব'- এই শিরোনামে মাঠে একটি সাইনবোর্ডও টানিয়েছেন আন্দোলনকর্মীরা।