ঢাকা নগরের লোকসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এই নগরের বাস্তবতা নিরিখে নগর পরিকল্পনাবিদরা গড়ে সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জন্য অন্তত তিন একর আয়তনের একটি খেলার মাঠ নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন। সে হিসাবে রাজধানীতে প্রায় এক হাজার ৬০০টি খেলার মাঠ থাকা প্রয়োজন। আদতে ঢাকায় খেলার মাঠ আছে মাত্র ২৫৬টি। এর মধ্যে বেশিরভাগ মাঠের আয়তনই তিন একরের নিচে। দুই সিটি করপোরেশনের এমন ৪১টি ওয়ার্ড রয়েছে, যেখানে নেই কোনো খেলার মাঠ। ৩৫টি ওয়ার্ডে মাঠ কিংবা পার্ক কিছুই নেই। অথচ দুই থেকে তিন দশক আগেও রাজধানীতে খেলার মাঠের জন্য এতটা হাহাকার ছিল না। কেন ঢাকায় হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার ও দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কারণেই মাঠ উধাও হয়ে যাচ্ছে। মাঠ যে অগ্রাধিকার পাওয়ার মতো বিষয়, কেউই তা আমলে নেয়নি। হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর এখন সবাই মাঠের প্রয়োজনীয়তা টের পাচ্ছে।
এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, যখন ঢাকা নগর তৈরি হয়, তখন পাড়া-মহল্লাভিত্তিক খালি জায়গা ও খেলার মাঠ ছিল। শহর যখন বড় হওয়া শুরু করে, তখন মাঠের জন্য জায়গা দান কিংবা অধিগ্রহণ কোনোটাই কেউ করেনি। মাঠ যে দরকার তৎকালীন মিউনিসিপ্যালিটি তা অনুভব করেনি। সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যেও কখনও খেলার মাঠ বা পার্ক ছিল না। সবকিছু শেষ হওয়ার পর মনে হচ্ছে মাঠগুলো গেল কই। এখন নতুন করে পার্ক বা খেলার মাঠ তৈরি করতে হলে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে কিংবা কাউকে দান করতে হবে। যেটা এখন আর কেউ করছে না।

তিনি আরও বলেন, গুলশান-বনানী-উত্তরার মতো সরকারি প্রকল্পগুলোর প্রকৃত লেআউট প্ল্যানকে ১০ থেকে ১২ বার কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। খেলার মাঠ নিয়ে অনেক খেলা হয়েছে। দফায় দফায় পার্ক-মাঠের জায়গাগুলোকে প্লট বানিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এভাবে অনেক পার্ক-মাঠ হারিয়ে গেছে। বেসরকারি প্রকল্পগুলোতেও তাই হচ্ছে।

আর একবার যদি কনস্ট্রাকশন হয়ে যায়, তখন 'আন ডু' করা যায় না। এখন প্রয়োজনে কিনে বা অধিগ্রহণ করে মাঠ নিশ্চিত করতে হবে।
এ ব্যাপারে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, আগে কী হয়েছিল সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলবেন না। তবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো খেলার মাঠ বা উন্মুক্ত স্থানকে প্লট বানিয়ে বরাদ্দ দেননি। বরং উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে একটি নতুন খেলার মাঠ তৈরি করে দিয়েছেন। এ ছাড়া পূর্বাচল, ঝিলমিল ও উত্তরা এলাকায় যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, খেলার মাঠ বা পার্কের জায়গা প্লট বানিয়ে কোনো ব্যক্তিকে বরাদ্দ দেওয়া হবে না। আর রাজউকের যে মাঠগুলো আছে সেগুলো হয় সিটি করপোরেশন, না হয় রাজউকই দেখভাল করবে।

পরিকল্পনাবিদদের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে জনপ্রতি ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা থাকা প্রয়োজন। রাজধানীতে আছে তার ৯০ শতাংশের এক শতাংশ। আর ১৫ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে থাকা উচিত একটি করে খেলার মাঠ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, প্রয়োজনে ছোট ছোট দুটি প্লট অধিগ্রহণ করে একটি ছোট খেলার মাঠ করতে হবে। এই কাজটি করতে হলে সিটি করপোরেশন, রাজউক, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অধিগ্রহণ করে সিটি করপোরেশনকে জায়গা বুঝিয়ে দিতে হবে। করপোরেশন সেখানে খেলার মাঠ ও পার্ক তৈরি করে দেবে। এ ছাড়া রাজধানীতে খেলার মাঠ ফিরিয়ে আনার আর কোনো সুযোগ নেই।

এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'নাগরিক সুবিধা দেওয়ার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আমাদের মেয়র প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে খেলার মাঠ করতে চান। গণপূর্ত, রাজউক, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মতো সংস্থাগুলোর সহযোগিতা পান না। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, শাজাহানপুরে গণপূর্তের মালিকানাধীন কয়েক একর খোলা জায়গা ছিল। ডিএসসিসি চেয়েছিল ওই জায়গা তাদের দিলে সেখানে মাঠ-পার্ক বানিয়ে এলাকাবাসীর কাছে হস্তান্তর করবে। গণপূর্ত সেটা ডিএসসিসিকে দেয়নি। কয়েক বছর আগে ওই জায়গা শাজাহানপুর থানা ও র‌্যাব-৩-এর নামে বরাদ্দ দেয় গণপূর্ত। এখন সেখানে ছয়তলা শাজাহানপুর থানা কমপ্লেক্স ও র‌্যাবের কার্যালয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। তাহলে রাজধানীতে খেলার মাঠ বাড়বে কীভাবে? অথচ ডিএসসিসিকে দিলে সেখানে মাঠ নিশ্চিত করা যেত।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) খেলার মাঠ-পার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, ঢাকা শহরের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, এক কাঠা জমিও খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন ডিএনসিসি প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে যাতে প্রয়োজনীয় মাঠ রাখা যায় সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

সংশোধিত ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নের আগে রাজউক একটি জরিপ পরিচালনা করে। সেই জরিপে দেখা যায়, দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডে এক হাজার ১৩৭ একর জায়গায় পার্ক থাকার কথা। সেখানে আছে মাত্র ২৭১ একরে। খেলার মাঠ থাকার কথা এক হাজার ৮৭৬ একর জায়গায়। আছে মাত্র ২৯৪ একরে। ড্যাপের জরিপে তেঁতুলতলা মাঠটিও উন্মুক্ত স্থান হিসেবেই চিহ্নিত করা আছে।
এদিকে, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠে মার্কেট তৈরি করে আয় বাড়ানোর জন্য ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। অনেক শিক্ষাঙ্গনে মাঠ থাকলেও ক্লাস শেষে ফটক বন্ধ করে দেওয়ায় শিশু-কিশোররা বিকেলে আর ওই মাঠে খেলতে পারে না। মিরপুর ১০ নম্বরের শহীদ আবুল তালেব উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি খেলার মাঠ ছিল। সেখানে স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানসহ স্থানীয় শিশু-কিশোর ও শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করত। বানানো হয়েছে মার্কেট। এ ছাড়া আবাসন প্রকল্পগুলো প্লট বেচার সময় লে-আউট প্ল্যানে খেলার মাঠ, পার্ক, উন্মুক্ত স্থান দেখালেও প্লট বেচার পর সেগুলোকেও আবার প্লট বানিয়ে বিক্রি করছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, 'আমি রাজউকের কাছে আবাসন প্রকল্পগুলোর লে-আউট প্ল্যান চেয়েছি। আমি দেখব নকশা অনুযায়ী তারা সেগুলো রেখেছে কিনা। যে রাখবে না তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। রাস্তার জায়গা, খেলার মাঠ কাউকে দখল করতে দেওয়া হবে না।'

রাজউকের জরিপ বলছে, ডিএনসিসির ১৭টি ওয়ার্ডে যে কয়টি খেলার মাঠ ও পার্ক রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ২৭টি ওয়ার্ডে আছে শুধু খেলার মাঠ। আর ১০টি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ ও পার্ক কোনোটিই নেই। ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডের ২৫টিতে খেলার মাঠ ও পার্ক কোনোটিই নেই। ১১টিতে কেবল পার্ক ও ৩৯টিতে যৎসামান্য খেলার মাঠ রয়েছে।

ড্যাপ প্রণয়নে সম্পৃক্ত নগর পরিকল্পনাবিদ হিশাম উদ্দিন চিশতি বলেন, পরিকল্পিত ও মানসম্মত আবাসিক এলাকায় প্রতি সাড়ে ১২ হাজার জনসংখ্যার জন্য এক একর জায়গায় পার্ক ও দুই একর জায়গায় খেলার মাঠ থাকার কথা। তাদের জরিপে প্রয়োজনের ছয় ভাগের এক ভাগও পাওয়া যায়নি। যেটুকু খেলার মাঠ তারা পেয়েছেন, সেগুলোরও বেশ কিছু সাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়।