সরকার বীরাঙ্গনাদের যেসব সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করেছে, তা পেতেও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায়।

টিআইবি বলছে, একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব নারী (বীরাঙ্গনা) পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের দ্বারা নির্যাতনে শিকার হয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানে সরকারের যথাযথ উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। একইসঙ্গে চিহ্নিত হওয়ার পর বীরাঙ্গনার নাম গেজেটে যুক্ত করতেও নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।

বৃহস্পতিবার 'বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায়' শীর্ষক টিআইবির এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

এ উপলক্ষে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সংস্থাটি। গবেষণাটি উপস্থাপন করেন সংস্থাটির রিসার্চ এসোসিয়েট রাবেয়া আক্তার কনিকা।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে গেজেটভুক্ত মোট বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৪৪৮ জন হলেও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এমআইএস-এ এন্ট্রি রয়েছে ৪০২ জনের তালিকা। 

একজন বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, 'হেরা তো কয় ঘর পাইতে হইলে তো টাকা পয়সা কিছু খরচ করতে হইবো। সরকার তোমারে এতো লাখ ট্যাকার ঘর দিবো, তোমারেও তো কিছু দিতে হইবো...লাখ খানেক টাকা চায়...তা না হইলে ঘরের নাকি ব্যবস্থা হইবো না।'

গবেষণায় উঠে আসে, ২০১৫ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে বীরাঙ্গনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রদানের সরকারি কার্যক্রম শুরু হয়। 

কিন্তু শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রাপ্তির এই প্রক্রিয়ায় বীরাঙ্গনাদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। গেজেটভুক্তির আবেদন হতে শুরু করে গেজেটভুক্তি জন্য সর্বোচ্চ কতদিনে মধ্যে কার্যক্রম নিষ্পত্তি করতে হবে তার জন্য কোনো নির্দিস্ট সময়সীমা আইনে বা বিধিতে উল্লেখ নেই। 

ফলে গেজেটভুক্তির এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অনেক ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সময়- কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩ বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। এছাড়া বীর নিবাসের ঘরের জন্য আবেদন করলে তা পেতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। 

এক্ষেত্রে সময়ের কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে আবেদন করার ৬ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও কেউ কেউ এখনো ঘর পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণার বরাত দিয়ে রাবেয়া আক্তার কনিকা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পরে হলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান সরকারের একটি অনন্য পদক্ষেপ। তবে বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পুরো প্রক্রিয়ায় নানা ঘাটতি বিদ্যমান। 

তিনি বলেন, বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রাপ্তির প্রক্রিয়া যেখানে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক সেখানে পরিকল্পনাহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি, কাঠামোগত জটিলতা, অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ, জবাবদিহি ব্যবস্থা ও সংবেদনশীলতায় ঘাটতি প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে তুলেছে। তার সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা ও সংবেদনশীলতার ঘাটতিও লক্ষণীয়। 

কনিকা বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও সামাজিক মূল্যবোধে অনেকাংশেই স্থবিরতা রয়ে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বীরাঙ্গনারা এখনো প্রান্তিকীকরণের শিকার। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি ও নারী বিষয়ক প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়ার নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক কাজ থাকলেও তা নারী বিষয়ক অন্য যেকোন কাজের তুলনায় বেশ অপ্রতুল।

তিনি আরও বলেন, বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রদানের এই প্রক্রিয়াটি গতানুগতিক অন্যান্য প্রক্রিয়া হতে ভিন্ন। কিন্তু বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির পুরো প্রক্রিয়াটি গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিনির্ভর। সংবেদনশীল এই বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় না রাখার কারণে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বীরাঙ্গনাদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই জটিলতার সৃষ্টি করছে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া একটি অনন্য উদ্যোগ। তবে তাদেরকে গেজেটভুক্ত করতে নানা ধরনের জটিলতা এবং সুযোগ সুবিধা পেতে ঘূষ ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বীরঙ্গনাদের স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটির ঘাটতি রয়েছে।