- রাজধানী
- হাটে হাটে জ্যাকেট আর লাঠি বাহিনী
হাটে হাটে জ্যাকেট আর লাঠি বাহিনী
রাজধানীর কোরবানির পশুর হাট

গাবতলী পশুর হাটে দূরদূরান্ত থেকে আসা গরুর ব্যাপারীদের ইচ্ছা না থাকলেও ঢুকতে বাধ্য করে লাঠি বাহিনী। বুধবার রাতের ছবি মাহবুব হোসেন নবীন
আঁধারের বুকে আলোর ছটা। লাল-নীল-বেগুনি বাতিতে ঝলমল। রাজধানীর গাবতলীর পশুর হাটের চারপাশটা এমনই রঙিন। বুধবার মধ্যরাত। জমজমাট হাটে রাত ২টার দিকে সুদূর নওগাঁ থেকে ট্রাক ভরে গরু নিয়ে গাবতলীর হাটে পা ফেললেন পারভেজ ব্যাপারী। কোরবানির পশু বেচতে এবারই প্রথম রাজধানীযাত্রা, এসেই তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। তাঁদের পরনে বিশেষ জ্যাকেট, হাতে হাতে লাঠি। হাটের একপ্রান্ত থেকে সবপ্রান্ত এই লাঠিয়াল যুবাদেরই আগ্রাসী দাপট। গরুবোঝাই ট্রাক হাটে ঢুকলেই তেড়েফুঁড়ে যাচ্ছেন সেদিকে। চালক ও ব্যাপারীকে জানিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের নির্দেশনা। কেউ কেউ আবার সড়ক থেকে জোর করে ট্রাক ঢোকাচ্ছেন হাটে। কোনো চালক নির্দেশ মানতে দেরি করলেই দেওয়া হচ্ছে গালাগাল এক চোট।
এসব দেখে খানিকটা ভড়কেই গেলেন পারভেজ ব্যাপারী।
পারভেজ বলেন, 'গ্রামে থাকি, শুনেছি গাবতলী বড় হাট। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল এখানেই গরু বিক্রি করব। জোরাজুরি না করলেও এখানেই গরু নামাতাম। এখানে যেসব তামাশা দেখছি, আর গরু নিয়ে আসব না ঢাকায়।'
গরুবোঝাই ট্রাক একবার হাটে ঢোকানোর পর চাইলেও তা অন্য হাটে নেওয়ার সুযোগ নেই। খানিকটা বাদেই মিলল এর সত্যতা। হাটের পেছনটায় আলো-আঁধারিতে হঠাৎ হট্টগোল। এগিয়ে যেতেই দেখা গেল, গরু অন্য হাটে নেওয়ার চেষ্টা করায় ইজাদারের লোক পরিচয়ে ৪-৫ জন এক ট্রাক চালককে শাসাচ্ছেন।
রাতের বয়স যত বাড়তে থাকল, হাটও জমতে লাগল। অনেক ক্রেতার সঙ্গী পরিবার-পরিজন। ধানমন্ডি থেকে গাবতলীর হাটে গরু কিনতে আসা আরিফ হোসেন বলেন, 'প্রতিবছর পরিবারের সবাইকে নিয়ে গরু কিনতে আসি। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। দাম কম-বেশি যাই হোক, সবাইকে নিয়ে কেনার মজাটা আলাদা।' গরুবোঝাই ট্রাক একে একে আমিনবাজার ব্রিজ পেরিয়ে যখন ঢাকায় ঢুকছিল, তখন প্রবেশপথে গাড়ির দীর্ঘ জট। আবার শত শত মানুষ সেখানে অপেক্ষমাণ ঢাকা ছাড়ার। তাই সড়কের উভয় পাশে ব্যস্ততা। গাবতলী ছাড়াও রাজধানীর আরও কয়েকটি পশুর হাট ঘুরে একই ধরনের 'জ্যাকেট বাহিনী'র প্রভাব চোখে পড়ল। তাদের কারণে অনেক ব্যাপারী মনের মতো হাটে পশু ভেড়াতে পারছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার প্রবেশপথগুলোর আশপাশের অস্থায়ী পশুর হাটগুলোতে সক্রিয় রয়েছে ইজারাদারদের লাঠিয়াল বাহিনী। ভয়ে ব্যাপারীরা টুঁ শব্দও করতে পারছেন না। পরিকল্পনার বাইরে বাধ্য হয়ে লাঠিয়ালদের নির্দেশে তাঁরা অন্য হাটে গরু নামাতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্যাপারী রফিকুল্লাহ জামালপুরের ইসলামপুর থেকে ১৮ গরু নিয়ে ঢাকায় ঢুকেছেন। প্রতি বছরের মতো এবারও তিনি ট্রাকবোঝাই গরু নিয়ে যাচ্ছিলেন পুরান ঢাকার অস্থায়ী পশুর হাটে। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের তিব্বত মোড় পার হতেই গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে লাঠি আর বিশেষ জ্যাকেট পরা একদল তরুণ রফিকুল্লাহর ট্রাক আটকে দেয়। একরকম জোর করেই ট্রাকটি পাশের ঢাকা পলিটেকনিক খেলার মাঠের (কলোনি বাজার এলাকা) অস্থায়ী হাটে নিয়ে ঢোকায়।
রফিকুল্লাহ ক্ষোভের সুরেই বলছিলেন, পথেই খবর পেয়েছিলাম এবার পুরান ঢাকার নয়াবাজারে হাট বসবে না। তাই ওই এলাকার ধোলাইখাল হাটে গরু নেওয়ার চিন্তা করছিলাম। তবে পথেই লাঠিয়ালরা জোর করে ট্রাকটি কলোনিবাজার হাটে নিয়ে যায়।
রফিকুল্লাহর কথার সূত্র ধরে বিশেষ জ্যাকেট পরা সেই তরুণদের গতকাল দুপুরে পাওয়া গেল মগবাজার-মহাখালী সড়কের তিব্বত মোড়ে। তাঁদের সবার হাতে লাঠি। পশুবাহী ট্রাক এলেই তা আটকে দিচ্ছিলেন তাঁরা। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ওই তরুণরা ঘটনাস্থল থেকে লুকানোর চেষ্টা করছিলেন। নাম প্রকাশ না করেই লাঠি হাতে একজন দাবি করলেন, তাঁরা পশুবাহী ট্রাকের নিরাপত্তায় কাজ করেন। কেউ হাটে পশুর ট্রাক ঢোকাতে চাইলে সহায়তা দেন। ২৪ ঘণ্টা ধরেই পালাক্রমে তাঁরা হাটের ইজারাদারের হয়ে এই দায়িত্ব পালন করছেন। জোর করে কারও গরু হাটে নেওয়া হয় না।
কোরবানি ঈদ ঘিরে রাজধানীর অস্থায়ী প্রায় সব পশুর হাটের আশপাশে রয়েছে এই লাঠিয়ালদের দাপট। পশুবাহী ট্রাক দেখলেই চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেন তাঁরা। এরপর জোর করে তা নিজেদের হাটে নিয়ে যান।
একই হাটে টাঙ্গাইল থেকে ১৪টি গরু নিয়ে এসেছেন হবিউল ইসলাম হবি। তিনি জানালেন, শ্যামপুরে তাঁর যাওয়ার কথা ছিল। এলাকার এক লোক আগেই শ্যামপুরে গরু নিয়ে এসেছিলেন। পরিবেশ ভালো হওয়ায় তিনিও যেতে চাইছিলেন সেখানে। তার আগেই রাস্তা থেকে লোকজন ট্রাক আটকে এই হাটের ভেতরে নিয়ে যায়।
গত বুধবার মধ্যরাতে পুরান ঢাকার ধোলাইখালে অস্থায়ী পশুর হাটে কথা হয় আব্দুস সাত্তার নামের এক পাইকারের সঙ্গে। তিনি ফরিদপুরের সালথা থেকে ১২ গরু নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। সাত্তার বলছিলেন, চিটাগাং রোডের হাটে তিনি প্রত্যেক বছর গরু বিক্রি করেন। এবার ধোলাইখাল দিয়ে ওই হাটে যাওয়ার পথে লোকজন গরুগুলো এই হাটেই (ধোলাইখাল) নামিয়ে রাখেন। তবে হাটে জায়গা ভালো পেয়েছেন, ক্রেতাও মিলছে।
ওই হাটে ফরিদপুরের সদরপুরের ব্যাপারী সাইজুল ইসলাম বলেন, 'হাটের লোকজন আগেই যোগাযোগ করায় আমি এই হাটেই এসেছি। তবে পথে কেরানীগঞ্জে একদল লোক আমার ট্রাক আটকে ওই এলাকার হাটে নিতে চেয়েছিল। পরে ধোলাইখালের ইজারাদারদের ফোন দিলে ট্রাক ছেড়ে দেয়।'
বছিলা পশুর হাট :বুধবার রাতে বিভিন্ন জেলা থেকে পশুবোঝাই গাড়ি এসে ভিড়তে থাকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বছিলা ৪০ ফিট হাটে। রাস্তার দুই পাশে পল্গট করে রাখা জমিতে সারি সারি বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা পশু। বছিলার এ হাটের ইজারা পেয়েছে মেসার্স শাহীন ইন্টারন্যাশনাল। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক আমজাদ হোসেন দারুস সালাম থানা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য। কয়েক বছর ধরে তিনি এ হাটের ইজারা পেয়ে আসছেন।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে অনেক ক্রেতা ঢুঁ মারছেন হাটে। দাম পরখ করে দেখছেন। সরেজমিন দেখা গেছে, হাটের বড় সমস্যা মশা। খড় পুড়িয়ে মশা তাড়ানোর চেষ্টা করছেন ব্যাপারীরা। গরু বিক্রেতারা বলেন, মশার জন্য দাঁড়ানো যাচ্ছে না। গরুরও সমস্যা হচ্ছে। হাটে পর্যাপ্ত ছাউনির ব্যবস্থা থাকলেও একটু বৃষ্টি হলেই কাদাপানিতে একাকার হতে হচ্ছে। ব্যাপারীরা অভিযোগ করেছেন, পানির ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ সারাদিন না দিয়ে কেবল রাতে সংযোগ দেওয়া হয়।
মশা ও পানি ছাড়াও এ হাটে চাঁদাবাজির মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। রাত সাড়ে ১২টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে ১৫ গরু নিয়ে হাটে ঢোকেন ব্যাপারী আব্দুল মোমেন। ট্রাক থেকে গরু নামিয়ে ফাঁকা স্থানে বাঁধতে গেলে বাধা দেন কয়েক ব্যক্তি। গরু রাখতে টাকা দাবি করেন তাঁরা। মোমেন তাঁদের এক হাজার টাকা দেন। পরে হাট কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে, তারা এসে ওইসব লোককে খুঁজে পায়নি।
ব্যাপারীরা বলছেন, মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে এলেই ৮ থেকে ১০ জন যুবক ট্রাক থামিয়ে টাকা দাবি করে। তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকে ছোট ছোট লাঠি। বেশ কয়েকজনের পরনে 'ইজারাদার গাবতলী' লেখা এবং হলুদ পোশাক। তারা ট্রাক আটকে ঈদের খরচ দাবি করে। অবশ্য ব্যাপারীদের অভিযোগের পর সরেজমিন মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে গিয়ে এমন কাউকে পাওয়া যায়নি। গতকাল দুপুরেও ওই স্থানে গিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবলের কাছে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে ট্রাক আটকে দেওয়ার ঘটনা পুরোনো। এ মুহূর্তে কেউ না থাকলেও, প্রায়ই এখানে ইজারাদারের লোকরা চাঁদাবাজি করেন।
১৩ গরু নিয়ে গত বুধবার চুয়াডাঙ্গা থেকে বছিলার এ হাটে এসেছেন রাকিব হাসান। তিনি বলেন, আমার গরু একটি স্থানে রাখার জন্য এ হাটে ১০-১৫ হাজার টাকা দিতে হবে। অর্ধেক টাকা জমা দেওয়া আছে। এবার হাটের লোক অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে। ডাকাতি চলছে। গরু বিক্রি করতে না পারলেও এই টাকা আমার পকেট থেকে যাবে।
কুষ্টিয়ার মিরপুরের হালসা গ্রামের একজন খামারি বলেন, এখানে শুধু বাল্ক্ব জালানো হয়। ফ্যান লাগাতে হলে সাতশ টাকা দিতে হবে। ভালো জায়গায় পশু রাখতে হলেও গুনতে হয় বাড়তি টাকা। গরুর খুঁটিপ্রতি যে টাকা নেওয়া হয়, তার জন্য কোনো কাগজপত্র বা রশিদ দেওয়া হয় না।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বুধবার রাত ১টার দিকে হাট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েকবার চেষ্টা করেও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে গতকাল বিকেলে ইজারাদার মো. আমজাদ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাটে চাঁদাবাজি নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে আছে।
মন্তব্য করুন