- রাজধানী
- কক্সবাজারে প্রাকৃতিক অবক্ষয় ও আন্তর্জাতিক আইন
রোহিঙ্গা
কক্সবাজারে প্রাকৃতিক অবক্ষয় ও আন্তর্জাতিক আইন

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপুল অনুপ্রবেশের ফলে কার্যত বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরের আয়োজক। কক্সবাজারের কুতুপালং-বালুখালী এলাকায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা 'শরণার্থী' রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, অতীতের শরণার্থী, কক্সবাজারের স্থানীয় সম্প্রদায়সহ ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গার মোট সংখ্যা ১ দশমিক ৫ মিলিয়নের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষ ইতোমধ্যে কক্সবাজার অঞ্চলের অবনতিশীল পরিবেশে অবিশ্বাস্য প্রভাব বিস্তার করেছে।
২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) ও ইউএন উইমেন পরিচালিত এক সমীক্ষায় প্রকাশ করা হয়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ মোট ৪ হাজার ৩০০ একর পাহাড় ও বন হারিয়েছে, যা অস্থায়ী আশ্রয়, সুযোগ-সুবিধা ও রান্নার জ্বালানি ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে কাটা হয়েছিল। মোট প্রাকৃতিক বনভূমির প্রায় অর্ধেক (১৫০২ হেক্টরের মধ্যে ৭৯৩ হেক্টর) দখল করা হয়েছে। পাহাড়ি ভূমি টেকনাফ-উখিয়া-হিমছড়ি সংকট এলাকায় ৩-৪ চার হাজার একর ভূমির (১২০০-১৬০০ হেক্টর) গাছপালা কেটে পরিস্কার করা হয়েছে। প্রতি মাসে গৃহস্থালির জ্বালানি হিসেবে প্রায় ৬ হাজার ৮০০ টন কাঠ সংগ্রহ এবং একটি রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য অস্থায়ী আশ্রয় নির্মাণে গড়ে ৬০টি বাঁশ ব্যবহার করার ফলে এটি ঘটেছে।
এভাবে নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে বর্ষাকালে এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা বেড়ে গেছে। এ ছাড়া 'শরণার্থীদের' পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে খনন করা হাজার হাজার অগভীর নলকূপ জলাশয়ের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ধিত যানবাহন ও 'শরণার্থীদের' পোড়ানো কাঠের আগুনের ফলে বায়ুদূষণজনিত রোগের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। যেহেতু পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থা নেই, ফলে পলি ব্যাগ ও প্লাস্টিকের বোতল পরিবেশের দূষণ ঘটায় এবং বঙ্গোপসাগরকে প্লাস্টিক দূষণ বৃদ্ধির হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের এই পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি বিশাল হুমকি তৈরি করেছে। এ বিষয়ে ইউএনডিপি প্রতিবেদনে (২০১৮) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে এলাকার জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব অপরিবর্তনীয় হবে।
বাংলাদেশ সরকার ওপরে বর্ণিত প্রাকৃতিক অবক্ষয়জনিত সমস্যা জাতীয় পর্যায়ে ব্যবহূত পরিবেশ আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী মোকাবিলা করতে বাধ্য। কিন্তু এই পরিবেশগত অবক্ষয় ও জীববৈচিত্র্যের অপরিবর্তনীয় ক্ষতির হুমকি একটি ট্রান্স-বাউন্ডারি সমস্যার কারণে হয়েছে। যার পেছনে একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কোনো দায় নেই। পাশাপাশি বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ ও বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীসহ সমস্যাটি নিজে যথাযথ সমাধান করতে যথেষ্ট সক্ষম নয়। যদিও বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিকল্প জ্বালানি, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রতিস্থাপনে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবু এ অঞ্চলে 'ইকো রিস্টোরেশন'-এর উদ্যোগ এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ কারণে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের এমন অপ্রত্যাশিত অবক্ষয়ের বিষয়টি, যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ত্বরান্বিত এবং স্থানীয় ও বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখছে, তা আন্তর্জাতিক ও বহুপক্ষীয় পরিবেশগত আইনের আলোকে দেখা উচিত।
আন্তর্জাতিক ও বহুপক্ষীয় পরিবেশগত চুক্তির মধ্যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রাসঙ্গিক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে আইন, সেটি হলো- ১৯৯৪ সালের 'বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি কনভেনশন' (সিবিডি)। প্রথমত, কনভেনশনের উদ্দেশ্য ধারা (অবজেকটিভ ক্লজ) অনুযায়ী, কক্সবাজার অঞ্চলের পরিবেশগত অবনতির জন্য মিয়ানমার দায়ী। কারণ এই অবক্ষয় তাদের কর্মকাণ্ডের ফল। যার জন্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এটি কনভেনশনের উদ্দেশ্য ধারা থেকে স্পষ্টভাবে অনুমানযোগ্য, প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব এটা নিশ্চিত করা যে তাদের কোনো ক্রিয়াকলাপ বা এখতিয়ারের মধ্যে সংঘটিত কোনো ক্রিয়াকলাপ অন্য কোনো রাষ্ট্রের পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে না অথবা জাতীয় এখতিয়ার-সীমার বাইরের এলাকার পরিবেশের ক্ষতি করবে না (ধারা-৩, সিবিডি ১৯৯৪)।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ওই কনভেনশনের পক্ষ হওয়ার কারণে (পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের ঘটনাটি বাংলাদেশের আঞ্চলিক এখতিয়ারের মধ্যে সংঘটিত হওয়ায়) বাংলাদেশেরও স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি মোকাবিলা এবং প্রতিরোধের দায়িত্ব রয়েছে (ধারা-৩, সিবিডি ১৯৯৪)। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, এ ধরনের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পালন করতে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাইতে পারে। এটি সিবিডির ৫ ধারা থেকে সুস্পষ্ট যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে প্রতিটি চুক্তিকারী পক্ষকে জাতীয় এখতিয়ারের বাইরের ক্ষেত্রে এবং পারস্পরিক স্বার্থের অন্যান্য বিষয়ে উপযুক্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে সরাসরি বা যেখানে প্রয়োজন, অন্যান্য চুক্তিকারী পক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। এই ধারাটির উদার ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ যৌক্তিকভাবে কেবল স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারেই নয়; রোহিঙ্গাদের আগমনের কারণে যে পরিবেশগত অবক্ষয় ঘটেছে, তার ক্ষতিপূরণ দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করার ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক সহযোগিতা চাইতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মিয়ানমারের বাধ্যবাধকতা শুধু সিবিডির উদ্দেশ্য ধারা থেকেই আসেনি, এটি আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইনের দূষণকারীর অর্থপ্রদান নীতির আলোকেও ন্যায়সংগত।
সর্বোপরি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবাধ প্রবেশে কক্সবাজার কিংবা টেকনাফে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হয়েছে, তা এ অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিকূলতাকে তীব্রতর করার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। তাই এ সমস্যাকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তির আলোকেও বিশ্বসম্প্রদায়ের গোচরে আনা যেতে পারে। ১৯৯৪ সালের ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) এবং ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু কনভেনশনের উদ্দেশ্য অর্জনে সব দেশ একে অন্যকে সহযোগিতা করার কথা বলা হয়েছে। সব সদস্য দেশ একে অন্যকে সহযোগিতা করা ছাড়াও উল্লিখিত জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলো সেসব উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে, যাদের এ ধরনের সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
অতএব, কক্সবাজার কিংবা টেকনাফ অঞ্চলের পরিবেশগত পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ যুক্তিযুক্তভাবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু কোনো প্রকার বৈশ্বিক সহযোগিতাই প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের পরিবেশ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে না; যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সফল প্রত্যাবাসন না ঘটে। তাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে উল্লিখিত দুটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মের শরণাপন্ন হওয়ার কথাও বিবেচনায় আনতে কোনো দোষ নেই। শেষ কথা, দ্বিপক্ষীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হোক বা না হোক, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশের কারণে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি বাংলাদেশে হয়েছে, তার জন্য মিয়ানমারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবির আইনি সুযোগ গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইনের ইতিহাসে চমৎকার একটি প্রায়োগিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে বাংলাদেশ।
মাহতাব শাওন: আন্তর্জাতিক আইনে পোস্ট ডক্টরাল গবেষক (ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্ক) এবং অ্যাডজাংক্ট প্রফেসর, গুয়েল্ফ বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
মন্তব্য করুন