বিদেশি গিফট আর পার্সেল প্রতারণা চক্রের মূলহোতাসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।মঙ্গলবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- বিপ্লব লস্কর, সুমন হোসেন ওরফে ইমরান, মোহসিন হোসেন ওরফে শাওন, ইমরান হাসান ওরফে ইকবাল, নাজমুল হক রনি, নুসরাত জাহান, নাইজেরীয় নাগরিক চিডি, ইমানুয়েল, জন, ক্যামেরুনের নাগরিক গুয়েগ্নি পাপিনি ও অ্যাঙ্গোলিয়ান উইলসন ডা কনসেকাও। 

গত সোমবার রাজধানীর মিরপুর, ভাটারা ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানা এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে ডিবির ওয়েব বেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম।

গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগজিন, ২৮টি মোবাইল ফোন, একটি কম্পিউটার, ৪৯১টি এটিএম কার্ড, ২৬টি চেক বই, ১ হাজার ৪১৫টি চেকের পাতা, তিনটি ওয়্যারলেস পকেট রাউটার, একটি প্রাইভেটকার, সাড়ে তিন লাখ জাল টাকা, ১১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, প্রতারণা সম্পর্কিত কথোপকথনের অসংখ্য স্ক্রিননশট ও ২৬৩টি সিমকার্ড উদ্ধার করা হয়। 

জানা যায়, চক্রের মূলহোতা গোপালগঞ্জের মোকছেদপুরের বাজারে কুলি হিসেবে কাজ করত বিপ্লব লস্কর। একসময় সে ঢাকার মিরপুরে এসে ফুটপাতে কাপড় বিক্রি শুরু করে। তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের প্রতারকদের। এরপর সে জড়িয়ে পড়ে 'পার্সেল প্রতারণা'য়। ফেসবুকে বন্ধুত্বের ফাঁদ পেতে উপহার পাঠানোর নামে এই প্রতারণার মাধ্যমে তিনি গত কয়েক বছরে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে। নামে-বেনামে রয়েছে তার হাজারখানেক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়ার টাকার ১০ শতাংশ পেত সে। আর বাকি ৯০ শতাংশ টাকা চক্রের বিদেশী সদস্যরা বিভিন্ন পণ্য কেনার মাধ্যমে নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দিত।

সংবাদ সম্মেলনে ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, প্রতারক চক্রের হোতা বিপ্লবের তিন ভাই এখনও কুলি (মালপত্র বহনের শ্রমিক) হিসেবে কাজ করেন। আর বিপ্লব হয়েছে কোটি কোটি টাকার মালিক। রাজধানীতে তার একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে। ঢাকার পাশের জেলায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছে। সেই বাড়িতেই মূলত প্রতারক চক্রের সদস্যদের নিয়ে সে আড্ডা জমাত এবং টাকা হাতানোর পরিকল্পনা করত। গ্রেপ্তার এড়াতে সে বিদেশি নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে যোগাযোগ করত। নিজের গাড়িতে সবসময় রাউটার ও নেটওয়ার্ক জ্যামার রাখত। এ কারণে তাকে গ্রেপ্তারে বেগ পেতে হয়েছে। 

তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও কাফরুল থানায় মানি লন্ডারিংয়ের মামলা আছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় শতাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগেও একাধিকবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, প্রতারণায় ব্যবহারের জন্য চক্রের সদস্যরা জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি পাসপোর্ট, ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংকে অসংখ্য অ্যাকাউন্ট খোলে। সেসব অ্যাকাউন্টের কার্ড ও চেকবই নিজেদের কাছে রেখে প্রতারণার অর্থ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার এটিএম বুথ ও ব্যাংকের শাখা থেকে তুলে নেয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে প্রতারণার টাকার ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বিপ্লব লস্কর তার বিদেশি নম্বর দিয়ে খোলা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বাংলাদেশি সহযোগীদের নির্দেশনা দিত।

ডিবি প্রধান জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা বিভিন্ন শহরের সাধারণ মানুষের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা সংগ্রহ করে ফেসবুকে মার্কিন সেনা বা নৌবাহিনীর কর্মকর্তা পরিচয়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। দ্রুত টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে। পরে দামি উপহার, স্বর্ণালংকার বা বিপুল পরিমাণ ডলার বা ইউরো পাঠানোর কথা বলে গিফটের ছবি ও রিসিট কপি পাঠায়। পরের ধাপে প্রতারক চক্রের 'কলিং বিভাগে'র সদস্য টার্গেট ব্যক্তিকে কল করে নিজেকে কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়। তারা বলে, আপনার নামে একটি পার্সেল এসেছে। পরে কাস্টমস হাউজ থেকে সেটি ছাড়ানোর নামে মোটা অংকের টাকা দাবি করা হয়। পার্সেল পাওয়ার আশায় ভুক্তভোগী প্রতারকদের দেওয়া ব্যাংক হিসাব নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেন। তখন সেই ভুয়া কাস্টমস কর্মকর্তা আবার ফোন করে বলে, পার্সেলে অবৈধ মালপত্র রয়েছে। তাই পার্সেল ছাড়াতে আরও বেশি টাকা লাগবে। আর টাকা না দিলে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করার ভয় দেখানো হয়। ভুক্তভোগী ঝামেলা এড়াতে আরও টাকা দেওয়ার পর তারা বলে, বিষয়টি পুলিশ ও সাংবাদিকরা জেনে গেছে। তাদের ম্যানেজ করতে আরও টাকা লাগবে। এভাবে নানা কৌশলে তারা বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়। শেষে ভুক্তভোগীকে কথিত বন্ধুর ফেসবুক অ্যকাউন্ট থেকে ব্লক করে দেওয়া হয়।