- রাজধানী
- অস্ত্রোপচার কক্ষে ১৪ বছর জ্বলে না আলো
অস্ত্রোপচার কক্ষে ১৪ বছর জ্বলে না আলো
মহানগর শিশু হাসপাতাল

আছে অপারেশন থিয়েটার। নেই সার্জারি বিশেষজ্ঞ; নেই অবেদনবিদ (অ্যানেসথেশিস্ট)। তাই ওই কক্ষে ১৪ বছর হয় না অস্ত্রোপচার; জ্বলে না আলো। রোগ পরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ থাকায় জমেছে ধুলো। যন্ত্রপাতি চালানোর কেউ নেই, তাই খোলাও হয়নি কখনও। জরুরি রোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে আছে একটি মাত্র অ্যাম্বুলেন্স। সেটির চালককে সরু গলি ভেদ করে রোগী নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতে প্রতিদিনই হতে হয় গলদঘর্ম। অচল স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা; শৌচাগারের হালও যাচ্ছেতাই।
এখন এমনই ছবি রাজধানীর লালবাগের গৌড় সুন্দর রায় লেনের মহানগর শিশু হাসপাতালের। ১৯৯০ সালে দক্ষ জনবল ও আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে ছোট পরিসরে শুরু হয় চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। ১৯৯৯ সালে যুক্ত হয় বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগের পরিষেবা। কিছুদিন না যেতেই ধুঁকতে থাকে চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রটি। এরপর দীর্ঘ ২২ বছর কেটে গেলেও সিটি করপোরেশন পরিচালিত হাসপাতালটি আজও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। এসব সমস্যা নিরসন ও হাসপাতাল আধুনিকায়নে ২০১৭ সালে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে অজানা কারণে থেমে যায় এই উদ্যোগের গতি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকরা বলছেন, আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচ আর সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে ১০০ শয্যার মহানগর শিশু হাসপাতাল থেকে রোগীরা পুরোপুরি সেবা নিতে পারছে না। আগের চিকিৎসকরা অবসরে যাওয়ার পর দেওয়া হচ্ছে না নতুন নিয়োগ। সেবায় পিছিয়ে থাকলেও আর্থিক সংকট নেই প্রতিষ্ঠানটির। সরকার থেকে হাসপাতাল পরিচালনার খরচ হিসেবে প্রতি মাসে মিলছে ৮৫ লাখ টাকার বেশি।
মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে ২০ থেকে ৩০ রোগী চিকিৎসা নেওয়ার অপেক্ষায়। আজিমপুরের আসাদ আলী দুই দিনের শিশু হাজেরাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তার শ্বাসকষ্ট। তাৎক্ষণিক অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হলেও হাসপাতালে সে ব্যবস্থা নেই। পরে হাজেরাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
হঠাৎ জ্বর দেখা দেওয়ায় দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে আশরাফ এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। চিকিৎসক দেখে ব্যবস্থাপত্রে পাঁচ ধরনের ওষুধ লেখেন। তবে হাসপাতাল থেকে মেলে দুই ধরনের ওষুধ। বাকি তিনটা বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে বলা হয়।
এ ব্যাপারে মহানগর শিশু হাসপাতালের ওষুধ স্টোরের দায়িত্বে থাকা কর্মচারী শফিউজ্জামান বলেন, বছরে দু'বার ওষুধ দেওয়া হয়। কোনো কোনোবার আগেই শেষ হয়ে যায়। তখন অপেক্ষা করতে হয়। বর্তমানে শ্বাসকষ্টজনিত রোগের ওষুধ সংকট রয়েছে।
ইসলামবাগের কবিতা বলেন, ছয় দিন শিশুকে নিয়ে ভর্তি আছি। হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে ওষুধ দেয়। তবে ওরস্যালাইন ও প্যারাসিটামল ওষুধ বেশি পাওয়া যায়। বাকি ওষুধ দোকান থেকে কিনে নিতে হয়। হাসপাতালের পরিচালক ডা. আহমেদ ক্কুদরতে খোদা বলেন, নিয়ম অনুযায়ী রোগীদের ৯০ শতাংশ ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়।
১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে মাত্র ২৭ রোগী ভর্তি রয়েছে। এই হাসপাতালে বিনামূল্যে সেবা পাওয়া যায়- অনেকেরই এ তথ্য অজানা। রোগীদের তিনবেলা খাবারের জন্য ১২৭ টাকা বরাদ্দ আছে। খাবারও তেমন মানসম্মত নয়।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে ২২ চিকিৎসকের পদ থাকলেও সেবা কার্যক্রম চলছে ১২ জন দিয়ে। নার্সের জন্য ৩৯টি পদ থাকলেও আছে মাত্র ১২ জন। হেলথ টেকনোলজিস্ট, কনসালট্যান্ট, অবেদনবিদ ও মেডিকেল অফিসারের অর্ধশতাধিক পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। সিটি করপোরেশন নার্সসহ অনেক পদের অনুমোদন দিলেও এখনও নিয়োগ দেওয়া যায়নি।
সংশ্নিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, এই হাসপাতালে পদোন্নতি ও বদলির সুযোগ এতই সীমিত যে খুব কম চিকিৎসক এখানে আসতে আগ্রহী। বর্তমানে হাসপাতালে ৯ জন মেডিকেল অফিসার ও তিনজন পরামর্শক কাজ করছেন। তাঁদের অর্ধেক আবার ডেপুটেশনে কাজ করছেন।
হাসপাতালটির পরিচালক ডা. আহমেদ ক্কুদরতে খোদা বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে বহির্বিভাগে সেবা নিচ্ছে ২০০ রোগী। অন্তর্বিভাগে গড়ে ৫০ জন সেবা নিচ্ছে। তবে হাসপাতালটি এখনও পুরোপুরি চালু করা যাচ্ছে না। আমাদের প্যাথলজি ও রেডিওলজি বিভাগ থাকলেও জনবল সংকটের কারণে বড় বড় পরীক্ষা এখানে করা সম্ভব হয় না। এমআরআই সিটি স্ক্যান মেশিন নেই। আমরা নিয়োগের জন্য একটি তালিকা পাঠিয়েছি। দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। নার্স নিয়োগের পরীক্ষা শেষ হওয়ায় দ্রুতই নির্বাচিতরা যোগ দিতে পারবেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, চিকিৎসক ডেপুটেশনের মাধ্যমে বাইরে থেকে আনার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া বড় সংখ্যক নার্স নিয়োগের নথি এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হয়ে গেলেই দ্রুত সময়ের মধ্যে নার্স কাজে যোগ দেবেন। একই সঙ্গে টেকনিশিয়ান নিয়োগের প্রক্রিয়াটিও চলমান।
মন্তব্য করুন