ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

কানের জোড়া দুল!

নরসিংদীর শিবপুরে প্রতিবেশীর নৃশংসতা

কানের জোড়া দুল!

এক জোড়া কানের দুলের লোভে গলা টিপে হত্যা করা হয় শিশু সায়মাকে। অভিযুক্ত প্রতিবেশী সেলিনা বেগম (ডানে)

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৩:৩৯

তিন কন্যা- সামা, সায়মা আর সামিয়া। সবাইকে নিয়ে সারোয়ার জাহান-হাসিনা দম্পতির সুখের পৃথিবী। প্রতিবেশীর নৃশংসতায় আনন্দের রাজ্য ছেড়ে হঠাৎ সায়মা উড়াল দিয়েছে অনন্তলোকে। সায়মা বোনদের মধ্যে দ্বিতীয়জন, দারুণ চটপটে। আট বছরের সায়মা শখ করেই দুই কানে ঝুলিয়ে রাখত স্বর্ণের দুল। কানের জোড়া দুলের জন্যই ছোট্ট মেয়েটি পারল না বাঁচতে। নিভিয়ে দেওয়া হলো প্রাণ প্রদীপ। হৃদয় কাঁপানো এ ঘটনা নরসিংদীর শিবপুরের নন্দারটেক এলাকার।

সায়মা স্থানীয় চর মরজাল মডেল কিন্ডারগার্টেনের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তাকে। বিকেলেও বাসায় না ফেরায় পরিবারের দুশ্চিন্তা বাড়ে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওইদিন সন্ধ্যায় প্রতিবেশীর ঘরের মিটসেফের ভেতর থেকে তার বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর বেরিয়ে আসে স্বর্ণের এক জোড়া দুলের জন্য শিশুটিকে গলাটিপে হত্যার কাহিনি। হত্যার পর মেয়েটির কান থেকে জোড়া দুল খুলে লুকিয়ে রাখে অভিযুক্ত ঘাতক।

শিশু হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেলিনা বেগম ও তার স্বামী মো. হানিফাকে। গতকাল বুধবার আদালতে জবানবন্দি ও মাত্র ১৮ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করার পর অভিযোগপত্রও জমা দিয়েছে পুলিশ। হত্যার পর এত দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়াকে রেকর্ড বলছেন সংশ্নিষ্টরা।
সায়মার স্বজন ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে সায়মাকে না পেয়ে এলাকায় মাইকিং করা হয়। পরে পুলিশের বিট অফিসার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে নিখোঁজের খবর পৌঁছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন সন্ধ্যার দিকে সায়মাদের বাড়িতে যাওয়ার পর তাঁরা জানান, দুপুরের দিকে প্রতিবেশী সেলিনা ও হানিফার বাড়িতে ওই শিশুকে দেখা গেছে। তবে ওই বাড়িতে খোঁজ নিলে তারা জানায়, অনেক আগেই সেখান থেকে চলে আসে সায়মা। স্থানীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেলিনার বাড়িতে পুলিশ গেলে ঘটনার নাটকীয় মোড় নেয়। সেলিনার পাঁচ বছরের শিশু রাইছা মনি হঠাৎ পুলিশকে বলে, 'আঙ্কেল, সায়মা আপু আমাদের ঘরে আছে। মা না ওকে গলাটিপে দিয়েছে।' এরপর সেলিনার বাসায় চিরুনি খোঁজে নামে পুলিশ। এক পর্যায়ে খাবার কক্ষে লোহার মিটসেফের দরজা তালাবদ্ধ দেখে সবার সন্দেহ হয়। তালা ভাঙার পর দেখা যায়, পুরোনো সাদা প্লাস্টিকের বস্তার ভেতরে শিশুর লাশ। এর পরই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেলিনা ও হানিফাকে শিবপুর থানা পুলিশ তাদের হেফাজতে নেয়। শিশুটিকে হত্যার কথা স্বীকার করেন সেলিনা।

সেলিনার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, তার দুই সন্তান। পাঁচ বছরের রাইছা ও দেড় বছরের ইব্রাহিম। সেলিনার স্বামী হানিফা অটোরিকশাচালক। মাসে দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় স্থানীয় রেহানা বেগমের টিনের দোচালা বাড়িতে বাস করেন। কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় সায়মার পরিবারের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক। সেলিনার মেয়ে রাইছার সঙ্গে খেলতে প্রায়ই তার বাসায় আসে সায়মা। মঙ্গলবার দুপুরে আসার পর কাঁঠালের বিচি খেতে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে সায়মার কানের দুলের ওপর নজর পড়ে তার। দুল খোলার চেষ্টা করলে শিশুটি বলে ওঠে- 'আমার কানে হাত দিতেছেন কেন। কেন আমার দুল চাইছেন। এই কথা মাকে বলে দেব।' এর পরই সায়মার গলাটিপে ধরেন সেলিনা। সাত-আট মিনিট গলাটিপে রাখার পর মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশ বস্তায় ভরে প্রথমে খাটের নিচে রাখে। এরপর মিটসেফের ভেতরে লুকায়। আর সায়মাকে হত্যার দৃশ্য দেখে ফেলে সেলিনার ছোট্ট মেয়ে রাইছা।
সেলিনা জানান, মেরে ফেরার দৃশ্য দেখে রাইছা এক পর্যায়ে কেঁদে দেয়। এরপর কারও কাছে মুখ না খুলতে নিজ সন্তানকে ভয় দেখায় সে। সেলিনার ভাষ্য, অভাবের কারণে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ভাড়ায় রিকশা চালিয়ে আসছিল তার স্বামী। ওই কানের দুল বিক্রি করে নিজেদের জন্য একটি রিকশা কেনার পরিকল্পনা ছিল তার। সপ্তাহখানেক আগেও একবার সায়মার কাছ থেকে কৌশলে তার দুল জোড়া নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। মঙ্গলবার দুল নেওয়ার সময় যখন ওর মাকে জানানোর কথা বলছিল তখন ভড়কে যায় সে।

নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজিম বলেন, 'নৈতিক অবক্ষয়ের বড় উদাহরণ এই ঘটনা। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত সময়ে তদন্ত শেষ করা হয়েছে। এতে সমাজে একটি বার্তা যাবে। ওই দুলের বাজারমূল্য মাত্র ৭ হাজার ৩০০ টাকা। এর জন্য এভাবে একটি শিশুকে হত্যা করা যায়- এটা সভ্য সমাজে অচিন্তনীয়।'
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রাসেল আহমেদ বলেন, 'শিশুটির পরিবার আমারও প্রতিবেশী। ওর বাবা পোলট্র্রি মুরগি ও ডিমের ব্যবসা করেন। মঙ্গলবার মাইকিং করার পর প্রথম ঘটনটি জানি। এরপর পুলিশসহ শিশুটির বাসায় যাই। সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া শেষে গতকাল পারিবারিক কবরস্থানে সায়মাকে দাফন করা হয়েছে।'
শিবপুর থানার ওসি সালাউদ্দিন মিয়া জানান, বিট পুলিশের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে। অভিযুক্তের তথ্য অনুযায়ী এরপর শিশুটির নিথর শরীর থেকে সরিয়ে নেওয়া কানের দুলও তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। নাপা সিরাপের খালি প্যাকেটের মধ্যে দুল জোড়া লুকিয়ে রেখেছিল সেলিনা। দুলের জন্য শিশুটিকে সে একা হত্যা করে। পরে তার স্বামী বিষয়টি জানে। এরপর লাশ লুকিয়ে রাখতে পরামর্শ দেয় সেলিনার স্বামী। মঙ্গলবার রাতে ঘরের ভেতরে থাকা লাশ অন্যত্র সরিয়ে ফেলার ছক ছিল সেলিনার। এ ছাড়া শুরুর দিকে এই ঘটনায় আরও একজন নারীকে জড়ানোর চেষ্টা করে সে। তবে সব তথ্য মিলিয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, এই ঘটনায় ওই দম্পতি জড়িত।






আরও পড়ুন

×