বাংলাদেশে চিত্রকলার ভুবনে অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করে অনন্তযাত্রায় পাড়ি জমিয়েছেন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী। গতকাল রোববার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শিল্পী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সমরজিৎ রায়চৌধুরীর পুত্র সুরজিৎ রায় চৌধুরী এ খবর নিশ্চিত করেছেন। সুরজিৎ জানান, শিল্পী দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ ও ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন।

একুশে পদক বিজয়ী বরেণ্য এ চিত্রশিল্পী ও শিক্ষকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার সন্ধ্যায় পৃথক শোকবার্তায় তাঁরা সমরজিৎ রায়চৌধুরীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
সোমবার সকাল ১০টায় শিল্পীর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হয়। সেখানে তাঁর মরদেহে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালেদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক উপকমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ, ঢাকা আর্ট কলেজ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, ছাত্রলীগসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বেলা সাড়ে ১১টায় সমরজিৎ রায়চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শহীদ মিনার থেকে দুপুর সাড়ে ১২টায় সমরজিৎ রায়চৌধুরীর মরদেহ সবুজবাগ কালীবাড়ি মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
সমরজিৎ রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা জেলায়। ১৯৬০ সালে তিনি তৎকালীন সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউট (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান চারুকলা অনুষদ) থেকে গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানের মতো শিল্পীদের শিক্ষক হিসেবে পান।
স্নাতক শেষ করে চারুকলা অনুষদেই শিক্ষকতায় যোগ দেন সমরজিৎ। ৪৩ বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০০৩ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যান। এরপর ২০১০ সাল পর্যন্ত শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির চারুকলা ও প্রদর্শন কলা বিভাগের ডিন হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭২ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে সদ্যপ্রসূত বাংলাদেশের সংবিধানের অঙ্গসজ্জায় অবদান রাখেন শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী। ১৯৮৯ সালে বাংলা একাডেমির অনুরোধে বৈদ্যুতিক টাইপরাইটারের জন্য বাংলা বর্ণমালার দুটি পৃথক বর্ণশৈলী (ফন্ট) তৈরি করেন।
সমরজিৎ রায়চৌধুরীর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। এতে তাঁর ৬০টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দৃশ্যান্তর বা মন্তাজ শীর্ষক একটি প্রদর্শনী করেন; যেখানে অ্যাক্রিলিক, জল রং, এচিং, ড্রইং, উডকাট, প্যাস্টেলের কাজসহ ৭১টি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়। তাঁর একক প্রদর্শনী ৫ ও দলীয় প্রদর্শনীর সংখ্যা ২৭।
আনুষ্ঠানিক শিল্পযাত্রার ৬২ বছরে সংখ্যার বিচারে বেশি ছবি প্রকাশ করেননি সমরজিৎ রায়চৌধুরী। সযত্ন সাধনায় তৈরি করেছিলেন নিজস্ব শিল্পভাষা, আঙ্গিক ও রীতি। একই সঙ্গে নিজের তৈরি শৈলীকেও ভেঙেছেন বারবার। তবে আদর্শে ছিলেন অটল। যে ফর্ম বা আঙ্গিকেই কাজ করেছেন, আপন দেশ, সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সেখানে প্রাধান্য বিস্তার করেছে।
মায়ের করা সূচিকর্মের নকশা শৈশব থেকে তাঁর মনে ছাপ ফেলেছিল। তাঁর প্রায় ছবিতেই সূচিকর্মের আদলে রেখা খুঁজে পাওয়া যাবে, যেটি তাঁর নিজস্ব রীতি। ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত নানা রকম জ্যামিতিক ফর্ম তাঁর ছবিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। তাঁর চিত্রকর্মে আত্মপ্রকাশ করেছে চিরায়ত বাংলার নানা রূপ ও মোটিফ। ঐতিহ্য ও আধুনিক রীতির সংমিশ্রণে শেষ পর্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন সমরজিৎ রায়চৌধুরী।
১৯৬০ সালে নিখিল পাকিস্তান টেপটাইল ডিজাইন প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন এবং একই বছর পান পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে টাইমটেবল কভার ডিজাইন পুরস্কার। সারাজীবনে অসংখ্য সম্মাননায় শিল্পী ভূষিত হয়েছেন। চিত্রকলায় অমূল্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে তাঁকে একুশে পদকে সম্মানিত করে।