নতুন ইতিহাস গড়ে উঠছে ইরানে। ১৬ সেপ্টেম্বর দেশটির হিজাব পুলিশের হেফাজতে ২২ বছর বয়সী কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। এর বিপরীতে সরকার দমননীতির আশ্রয় নেয়। হতাহতের সংখ্যা দুই শতাধিক। আন্দোলনের সামনের সারিতে রয়েছেন নারীরা। তবে এবারের আন্দোলনে যেভাবে ইরানের নারীরা সর্বস্তরের সমর্থন পাচ্ছেন, তা অভূতপূর্ব।

'নারী, জীবন, স্বাধীনতা'
'আমরা এক টুকরো কাপড়ের বিরুদ্ধে লড়ছি না। আমরা আমাদের সম্মানের জন্য লড়াই করছি। আমরা যদি আমাদের মাথার ওপরে কী চড়াব সেই সিদ্ধান্ত না নিতে পারি, আমাদের মাথার ভেতরে যা আছে, তার দায়-দায়িত্ব নিতেও আমাদের দেওয়া হবে না'- কথাগুলো ইরানে চলমান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের।
দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের নারীরা হিজাব বাধ্যতামূলক আইনের বিরোধিতা করে আসছেন। নারী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াসও ছিল। কিন্তু সফলতা খুব একটা ছিল না। নারীর চেয়ে সহজে পুরুষের বিয়ে বিচ্ছেদের সুযোগ, সন্তানের লালন-পালনে পুরুষের একচ্ছত্র অধিকার, পুরুষদের বহুবিবাহে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো এবং নারীর ভ্রমণের ক্ষেত্রে স্বামী বা বাবার অনুমতির মতো আইনের বিরোধিতা করে আসছেন তাঁরা।

এক ভিডিওতে দেখা যায়, নিহত মাহসা আমিনির শহর সাকেজের একটি সড়কে মিছিল করছে স্কুলছাত্রীরা। হিজাব হাতে নিয়ে মাথার ওপর দোলাতে দোলাতে তাদের মুখে স্লোগান ছিল- 'নারী, জীবন, স্বাধীনতা'। উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ মাজানদারানের ৩৪ বছর বয়সী শিল্পী মরিয়ম। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা শুধু তাঁদের হিজাব পোড়াননি, তাঁরা তাঁদের লম্বা চুল কেটে ফেলেছেন, এমনকি মাথা ন্যাড়া করেছেন। তিনি বলেন, 'এটি একটি ঘোষণা, যার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আপনারা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না এবং আমার চুল নিয়ে কী করব আপনারা নির্ধারণ করে দিতে পারেন না।'

ইসফাহানের ২৮ বছর বয়সী মানবাধিকারকর্মী গুলশান প্রতি রাতে বন্ধুদের ছোট একটি দল নিয়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। তাঁদের স্লোগানের মধ্যে রয়েছে- 'হিজাব নয়, নিপীড়ন নয়, শুধু সমান অধিকার'। বিক্ষোভের প্রথম রাতে গুলশান ও আরও ৫০ জনের মতো নারী একটি সড়কের মোড় অবরোধ করেন। তাঁরা পুরুষদের বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। পরে অনেক পুরুষ এই আন্দোলনে যোগ দেন। এক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের হর্ষধ্বনির মধ্যে নারীরা তাঁদের মাথা থেকে হিজাব খুলে ফেলেন, মাথার ওপর সেগুলো উড়াতে থাকেন এবং শেষে আগুনে ছুড়ে মারেন।

২০ বছর বয়সী ইয়াসি পরিবারের সঙ্গে বাস করেন তেহরানে। এবারের আন্দোলনের শুরুতেই ছুটে যান রাজপথে। তাঁর পরিবারে প্রথম নারী হিসেবে তিনি হিজাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তেহরানে প্রতি রাতেই বিক্ষোভ হচ্ছে। ইয়াসি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, 'আমার বারবার মনে হচ্ছিল আমিও মাহসা হতে পারি; আমার কোনো বন্ধু হতে পারে, আমার কোনো পরিচিতজন হতে পারে। কেউ জানে না গ্রেপ্তারের পর কী আচরণ করে তারা।' তাঁর মা মিনো নিজের মেয়ের মধ্যে মাহশাকে দেখতে পান। বেশ কয়েকটি রাতে ইয়াসি ও তাঁর বন্ধুদের তিনি গাড়ি চালিয়ে বিক্ষোভে যোগ দিতে নিয়ে গেছেন। মিনো বলেন, 'তিনি স্বেচ্ছায় হিজাব পরেন। কিন্তু এটি পরা বা না পরার অধিকার তাঁর থাকা উচিত, সরকারের নয়। আমরা যা ভাবি তা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। আমি ধার্মিক কিন্তু শাসকরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের আবর্জনার মতো বিবেচনা করে যে আচরণ করে যাচ্ছে, তাদের এই ভন্ডামি ও মিথ্যাচারে আমি হতাশ।'
'আমরা আর ভয় পাই না'

নরওয়েভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইরান হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত অন্তত ২১০ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কের সংখ্যা ২৩। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, অন্তত ২০ নিরাপত্তারক্ষী সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন।

বিক্ষোভকারীদের সমাবেশ ঠেকাতে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিরাপত্তাকর্মীদের দমনপীড়নের ছবি ছড়িয়ে পড়া বন্ধে ইরানের অনেক অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রেখেছে সরকার। এখনও দেশটির প্রায় ২৫ শতাংশ ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে রয়েছে।

তবে আন্দোলনকারীরা নিজেদের প্রতিবাদী বার্তা ছড়িয়ে দিতে নতুন সব কৌশল বেছে নিয়েছেন। তেহরানের কেন্দ্রস্থলমুখী একটি সড়কের ওভারপাসের ওপর তাঁরা বিশাল একটি ব্যানার টানিয়েছেন। তাতে লেখা, 'আমরা আর ভয় পাই না। আন্দোলন চালিয়ে যাব।'

তবে এবারের আন্দোলন হিজাব নিয়ে রক্ষণশীলতার গণ্ডি অতিক্রম করে পুরো অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে। ইরানি-কানাডীয় নারীবাদী লেখিকা নাজলি কামভারি বলেন, 'হিজাব হলো একটি প্রতীকী বস্তু, যা নারীদের সামনে ও কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। তাঁরা যেসব বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন, এটি সেগুলোর সঙ্গে তাঁদের যুক্ত করেছে।' ইরানের বর্তমান শাসকরা এখন জনগণের তোপের মুখে পড়েছে। বিক্ষোভের স্লোগানেই তার প্রমাণ মিলছে। 'স্বৈরশাসকের মৃত্যু হোক' কিংবা 'আমরা আমাদের ইরানকে ফিরিয়ে নিতে চাই'- এমন সব দাবি তুলছেন বিক্ষোভকারীরা।

চলমান আন্দোলনে মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিক শ্রেণি উভয় পক্ষই অংশ নিয়েছে। তারা স্থানীয় বা জাতিগত সমস্যা থেকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিষয়ে চলে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিক, তেল খনির শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী, মধ্যবিত্ত, এমনকি রক্ষণশীলদের একাংশও সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সুইডেনভিত্তিক ইরানি সমাজবিজ্ঞানী মেহরদাদ দারভিশপোর বলেন, 'এখন অনেক পুরুষ প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে, যাতে বোঝা যায় প্রগতিশীল দাবির প্রতি সমাজে পরিবর্তন এসেছে।' তিনি আরও বলেন, 'আমরা আসলে একটি মেগা আন্দোলনের জন্ম দেখছি।' এ আন্দোলনটি নারীদের নেতৃত্বে হচ্ছে কিন্তু তাঁরা অন্যদেরও আন্দোলনে শামিল করতে পেরেছেন। ভয় পেতে পেতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন আর ভয়ের কিছু থাকে না। ইরানের জনগণের অবস্থা অনেকটা এমনই। নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তাঁরা এখন আর ভয় পান না। যেখানে গড়ে উঠছে এক নতুন সংগ্রামের ইতিহাস।

শৃঙ্খল মুক্তির দিন
- ১৪ সেপ্টেম্বর মাহশা আমিনিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
- ১৬ সেপ্টেম্বর মাহশার মৃত্যুর কথা জানাজানি হলে সাকিজ শহরে শুরু হয় প্রতিবাদ।
- ১৭ সেপ্টেম্বর কুর্দিস্তানের অন্যান্য শহরও প্রতিবাদে যুক্ত হয়। সেখানে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্নাহ খামেনির বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে।
- ১৮ সেপ্টেম্বর তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে যুক্ত হয়। সেখানকার নারী শিক্ষার্থীরা হিজাব খুলে আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
-১৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে এক আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়।
-২০ সেপ্টেম্বর হিজাব ফেলে চুল কেটে প্রতিবাদ জানানো শুরু করেন নারীরা। আন্দোলন ইরানের ৩১টি প্রদেশের মধ্যে ১৬টিতে ছড়িয়ে পড়ে। তেহরান, কুর্দিস্তান প্রদেশসহ দেশটির একটা বড় অংশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
- ২১ সেপ্টেম্বর এক দিনে অন্তত ৩৪ জন নিহত হন। আন্দোলনের স্লোগানে পরিণত হয় 'নারী, জীবন, স্বাধীনতা '।
- ৩ অক্টোবর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ আন্দোলনকে বিদেশি চক্রান্ত বলে উল্নেখ করেন। আন্দোলনে স্কুলের কিশোরীরা ব্যাপকহারে যুক্ত হতে শুরু করে।
- ৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করা হয়।
-১৪ অক্টোবর আন্দোলন শুরুর পর অন্তত ২৩ শিশু-কিশোর নিহত হয়, যাদের বয়স ১১ থেকে ১৭ বছর। মোট নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক। া