বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যার নেপথ্য রহস্য বের করতে তথ্য যাচাই-বাছাই করছে একাধিক সংস্থা। এ ছাড়া বিভিন্ন আলামতের বিশ্লেষণও চলছে। এমনকি নিখোঁজের পর যেসব জায়গায় ফারদিনের অবস্থান ছিল, সেখানকার সিসিটিভির ফুটেজ আবারও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বেশ কিছু ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের পরীক্ষা করানো হবে।

ফারদিন হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত তাঁর বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরা ছাড়া অন্য কাউকে গ্রেপ্তারের খবর আনুষ্ঠানিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে জানানো হয়নি। তবে ডেমরা ও রূপগঞ্জসংলগ্ন চনপাড়া বস্তির চার-পাঁচজন গোয়েন্দা নজরে রয়েছে। তথ্য জানতে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তার দাবি, চনপাড়াকেন্দ্রিক অপরাধীদের দিকে তাঁরা সবচেয়ে বেশি নজর দিচ্ছেন। ৪ নভেম্বর ফারদিন নিখোঁজ হওয়ার রাতে চনপাড়া বস্তিতে হট্টগোলের ঘটনাটি আসলে কী নিয়ে হয়েছিল, তা আরও বিশদভাবে জানার চেষ্টা করছেন তাঁরা। প্রযুক্তিগত তদন্তের পাশাপাশি সোর্সের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত নেওয়ার চেষ্টা চলছে। ওই এলাকার গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের ধরতে গতকালও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ফারদিন হত্যার আদ্যোপান্ত বের করতে ছায়াতদন্ত করছে র‌্যাব। তথ্য জানতে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্টভাবে কিছু পাওয়া গেলে সবকিছু খোলাসা হতে পারে।

ডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁরাও গুরুত্ব দিয়ে এই মামলার তদন্ত করছেন। কিছু তথ্যের ব্যাপারে স্পষ্ট হতে ঘটনার শুরু থেকে তাঁরা আলামতের ক্লু মেলানোর চেষ্টা করছেন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তার ভাষ্য, কয়েক মাস ধরে ফারদিনের সঙ্গে কার, কেন যোগাযোগ হয়েছিল এসব তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। ঘটনার পর থেকে তদন্ত কর্মকর্তারা পলাশ বৈদ্য নামে আরেকজনের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছেন। এই নামে কারও সঙ্গে ফারদিনের যোগাযোগ ছিল কিনা তা বের করতে একাধিক সংস্থা কাজ করছে।

ফারদিনের লাশ উদ্ধারের পর অপরাধসাম্রাজ্য হিসেবে চনপাড়া বস্তির নামটি নতুনভাবে সামনে আসে। মাদক, অপহরণ, ছিনতাই, মলমপার্টি, প্রতারণার একাধিক গ্রুপ সেখানে সক্রিয়। এক লাখের বেশি লোকের বসতি চনপাড়ায়। সেখানে মাদকের আখড়া আছে ২শর বেশি। ফেনসিডিলের বড় কারবারির নাম 'বোতল মিজু'। হেরোইনের কারবারির নাম 'পাউডার হাসান' আর ইয়াবার বড় কারবারি হলো 'গুটি কাশেম'। চনপাড়া বস্তি যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁদের অন্যতম হলেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (চনপাড়া এলাকা) সদস্য বজলুর রহমান। এক সময় তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখনও চনপাড়ায় মাদক কারবারি তিনি। এলাকায় প্রভাবও ছিল তাঁর। মাদকের অভিযোগে ২০০৫ সালের শেষের দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে চনপাড়ায় ধরতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়। সে সময় রূপগঞ্জ এলাকার আওয়ামী লীগের এক নেতা বজলুল রহমানকে কাছে টানতে টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করেন। ওই নেতার হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন এই মাদক কারবারি।

ইউপি সদস্য বজলুর রহমানের বাড়ির পাশে সবজি চাষ করেন তাঁর মেয়ের স্বামী রিপন। সবজিক্ষেতের মধ্যে ফেনসিডিলের বোতল মাটিতে পুঁতে রাখা হয়, যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালালেও টের না পায়। এমনকি নজরদারি রাখতে সেখানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা আছে। সম্প্রতি এলাকাবাসীর কাছ থেকে তথ্য পেয়ে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে মাটির নিচ থেকে ফেনসিডিল জব্দ করে। স্ত্রীসহ রিপনকে আটক করা হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বজলুর রহমান টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ঘটনাস্থল থেকেই মেয়েকে ছাড়িয়ে নেন। রিপনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ।

নানা অপরাধীদের ঘাঁটি চনপাড়া বস্তিতে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা কমিশন ও দিনহাজিরায় কাজ করে। অজ্ঞান বা মলম পার্টির অন্যতম হোতা চনপাড়া সাত নম্বরের করিম ও তার ভাই ওমর। তারা প্রতিদিন ভোরে চক্রের সদস্যদের নগদ টাকা দেয় গাড়ি ভাড়া ও অচেতন করার দ্রব্যাদি কেনার জন্য। ওই টাকা নিয়ে সদস্যরা নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। সুযোগ বুঝে মানুষকে অচেতন করে অর্থ ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে এনে দেয় করিম ও ওমরকে। ওই মালপত্রের একটি কমিশন দেওয়া হয় সদস্যদের। তবে কোনোদিন টাকা-পয়সা লুট করতে না পারলে সেদিন নামকাওয়াস্তে একটা হাজিরা দেওয়া হয় তাদের।