- রাজধানী
- রাজধানীতে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাড়ছে নতুন মুখ
দ্রব্যমূল্যের কশাঘাত
রাজধানীতে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাড়ছে নতুন মুখ

রাজধানীর সদরঘাটে দীর্ঘদিন ব্যবসা করছেন সুমন মোল্লা। আগের মতো ব্যবসা নেই। আলাপকালে তিনি জানান, দিনে এখন তাঁকে অন্তত ২০০ ভিক্ষুক সামলাতে হচ্ছে। কাউকে দু-এক টাকা দিয়ে, কারও কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছেন। সুমনের ভাষ্য, এমন অবস্থা আগে ছিল না। স্থানীয় ভিক্ষুকরা কমবেশি সবারই চেনা। কিন্তু গেল দুই বছরে এ কাজে অনেক নতুন মুখ যুক্ত হয়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ভিক্ষা করছেন সখিনা বেগম (৬৫)। এখানের স্থায়ী ভিক্ষুকরা তাঁকে তাড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। আলাপকালে তিনি জানান, মানুষের বাসায় কাজ করে একমাত্র প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে ভালোই ছিলেন। করোনায় কাজ বন্ধ হয়ে কষ্টে দিন কাটে। এরপর কাজ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাকালে দ্রব্যমূল্যের কাছে হিমশিম খেতে হয়। দুই মাস আগে দুর্ঘটনায় একটি হাত বিকল হয়ে যায়, কেউ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে হচ্ছে।
সখিনা বেগমের মতো রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত হয়েছে নতুন মুখ। নিম্নবিত্তদের অনেকে কাজ না পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছেন। এমনকি ভিক্ষুকমুক্ত এলাকাতেও তাঁরা বসছেন। ফলে সারাদেশে ভিক্ষুক পুনর্বাসনে সরকারের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজধানীর সদরঘাটের ভিক্ষুক সমির আলী (৬৫) জানান, অল্পদিন হলো তিনি ভিক্ষা করছেন। স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে সংসার। ভ্রাম্যমাণ চা-সিগারেট বেচে দিব্যি চলে যেত। করোনায় পুঁজি হারিয়ে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। দ্রব্যমূল্যের চাপে এখন বাধ্য হয়ে মানুষের কাছে হাত পাতছেন। সমির আলী বলেন, শখ করে কেউ এ কাজ করে? আমিই কত মানুষকে ভিক্ষা দিয়েছি। এখন হাত পাতছি, এর চেয়ে কষ্টের কিছু নেই। তিনি আরও বলেন, করোনায় পুঁজি হারিয়ে খুব চাপে পড়ি। পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে ঠেলাগাড়ির কাজ নিই। কোমরে আঘাত পেয়ে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকি। এরপর আর কাজে ফিরতে পারিনি।
রাজধানীর শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, আজিমপুর, পুরান ঢাকা, সদরঘাট, বংশাল, মহানগর আদালত, লক্ষ্মীবাজার, শ্যামবাজার, ওয়ারী, পাটুয়াটুলি, নারিন্দা, কাঠেরপুল, বাংলাবাজার ঘুরে দেখা গেছে- সব জায়গাতেই ভিক্ষাবৃত্তিতে নতুন মুখের তথ্য মিলছে। মসজিদ, বাজার ও শপিংমল থেকে কেউ বের হলে একসঙ্গে ১৫-২০ জন ঘিরে ধরছেন। কেউ সাহায্য দেন, কেউ বিরক্ত হন।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের মধ্যে ভিক্ষুকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার ২০১০ সালে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেয়। এ প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ সালে রাজধানীর বিমানবন্দর, সোনারগাঁওসহ গুরুত্বপূর্ণ সাতটি এলাকা চিহ্নিত করে 'ভিক্ষুকমুক্ত' এলাকা ঘোষণা করে। এসব এলাকার ভিক্ষুকদের দোকান বা ক্ষুদ্র ব্যবসা, রিকশা-ভ্যান কিনে দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত (২০১০-১১ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর) ভিক্ষুক পুনর্বাসনে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৭৫ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ৩ হাজার ৫০ জনকে পুনর্বাসনে বরাদ্দ রয়েছে ১২ কোটি টাকা।
বর্তমানে ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধলা, গাজীপুরের পুবাইল ও কাশিমপুর, নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল, মানিকগঞ্জের বেতিলা ও ঢাকার মিরপুরে ভিক্ষুক-ভবঘুরেদের আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু স্বল্প সময়েই এসব কেন্দ্রের বেশিরভাগ সুবিধাভোগী আগের পেশায় ফিরে গেছেন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা অধিশাখার উপপরিচালক (ভিক্ষুক) শাহ জাহান বলেন, এখন ঢাকায় কতজন ভিক্ষুক আছেন, সে তথ্য আমার কাছে নেই। তবে আগে থেকে ভিক্ষুক বৃদ্ধি পেয়েছে। বরাদ্দের অর্থ নিয়ে খেয়ে ফেলে অনেকেই আবার ভিক্ষাবৃত্তিতে ফিরে গেছেন।
সমাজ গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবিউল ইসলাম বলেন, করোনার অভিঘাত, দ্রব্যমূল্যের কশাঘাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে ঢাকায় ভিক্ষুক বেড়েছে। গ্রামে কাজ নেই। বাধ্য হয়ে নিম্ন আয়ের বড় অংশ ঢাকামুখী। এখানেও তো কাজ নেই। ফলে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিচ্ছেন। সত্যিই পুনর্বাসন করতে চাইলে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে।
মন্তব্য করুন