ধাধার মতো এক জায়গা পুরান ঢাকা। এখানে প্রতিটি বাঁকে ছড়িয়ে আছে গৌরবময় অতীত এবং হাল আমলের উন্নয়ন-প্রবাহের দোদুল্যমান বাস্তবতা। এখানে লুকিয়ে রয়েছে নানা রকম চরিত্র, যা অন্য কোথাও দেখা যায় না। রয়েছে অগণতি গল্প। এমন গল্পগুলোই মুম্বাইয়ের প্রজেক্ট-৮৮ গ্যালারিতে মুনেম ওয়াসিফের একক প্রদর্শনীতে ফুটে ওঠে, যা পুরান ঢাকায় গত ২০ বছরে বেড়ে উঠেছে। পুরান ঢাকা, সেখানকার মানুষ ও দৈনন্দিন জীবনের মুনেম ওয়াসিফের অনুরাগের বহিঃপ্রকাশই ঘটেছে তাঁর 'ক্রমশ' প্রদর্শনীতে। ১০ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে প্রদর্শনীটি।

মুনেম ওয়াসিফ এক দশক জুড়ে 'বিলঙ্গিং ২০০১-২০১৩' সিরিজের ছবিগুলো তোলেন, যা প্রকাশিত হয় প্যারিসের 'ক্লেমেনতিঁ দে লা ফেরানিয়ের' প্রকাশনা থেকে। সাদাকালো এ সিরিজের কাজটিকে আপাতদৃষ্টিতে কিছু নির্দিষ্ট মুহূর্ত বা আকস্মিক ঘটনার সংকলন মনে হলেও, দীর্ঘ ১২ বছরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠার কারণে কাজটি এক কাব্যিক আখ্যানে রূপান্তরিত হয়। ২০ বছর আগের সাদাকালো ছবি, ছবির মানুষ, বাড়ি-ঘর, অলিগলি, দোকানের নাম, সাইনবোর্ড- সবকিছু যেন পাল্টে গেছে। ওয়াসিফ নতুন কাজ 'স্টেরিও' তাঁর লেন্সকে সরিয়ে আনেন শহরের মধ্যে খুঁজে পাওয়া নির্জীব বস্তুর স্থাপত্যে। প্রায় বিমূর্ত রঙিন এই ছবিগুলো শহরের নানা বিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আগের সাদাকালো কাজের পাশাপাশি প্রদর্শনীতে নতুন ছবিগুলোর সংযোজন দর্শককে পুরান ঢাকার সমসাময়িক বাস্তবতার দিকে নিয়ে যায়।

ওয়াসিফ এরপর 'খেয়াল' (২০১৫-১৮) চলচ্চিত্রটির নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। এটিকে তিনি বাস্তবতা এবং ফিকশনের মেলবন্ধন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। খেয়ালের প্রেক্ষাপট মূলত চারটি চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক জগতের মাঝেই ঘোরপাক খেতে থাকে; এখানে পুরান ঢাকা একটি উপলক্ষ মাত্র। খেয়াল জাদু বাস্তবতা, সাহিত্য ও পুরান ঢাকার নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের এক মিশেল।

প্রদর্শনীতে ওয়াসিফ ফিরে আসেন 'খেয়াল'-এর মূল চরিত্র, ওসমান আলীর কাছে। 'ওসমান ও তার সুবাস (২০২২)' আমরা দেখতে পাই পুরোনো শহরের অলিগলিতে ঘুরতে থাকা এক ব্যক্তি, যিনি গন্ধের জগতে ডুবে থাকেন। ধোঁয়া, শেওলাপড়া পুরোনো দেওয়াল, ধূপ, কর্পূর, আতর, পুরোনো বটবৃক্ষ, আগরবাতি, কাঁচাবাজারের হলুদ, মরিচ, বিভিন্ন মসলায় ঘেরা এক জগৎ। অদ্ভুত এক ঘোর! তার মধ্যেই আমরা দেখি ধোঁয়া ও কুয়াশায় আচ্ছন্ন একটি দরজার ছবি। কারণ ধোঁয়া হলো সুবাসের কায়া; তার একমাত্র দৃশ্যমান রূপ। শুধু আলোয় দৃশ্যমান এই দরজা ভিন্ন কিছুর দিকে আমাদের ইঙ্গিত দেয়, যেন ভিন্ন কোনো জগতের প্রবেশদ্বার! মুনেম ওয়াসিফের তৈরি দৃশ্যমান জগৎ আমাদের এক মৌলিক বোধের ইঙ্গিত দেয়, যা কিঞ্চিৎ অপার্থিব ও যাদের উপস্থিতি সবসময় টের পাওয়া যায় না; কিন্তু গন্ধের মতো তা বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার আগে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজের প্রভাব সঞ্চারিত করে যায়। কার্যত প্রদর্শনীর কাজগুলো শিল্পী এবং তাঁর শহরের মাঝে কয়েক দশক ধরে চলে আসা এক অন্তরঙ্গ কথোপকথন।