ওয়াসা কর্মকর্তারা ২০১১ সালের মার্চে হঠাৎ পুলিশ নিয়ে হাজির হন খুলনা নগরীর শেখপাড়া প্রধান সড়কের বাসিন্দা আকতার উদ্দিন পান্নুর বাড়িতে। তাদের দাবি, ১৯৯২ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৯ বছরে তাদের পানির বিল বকেয়া রয়েছে। অথচ তাঁরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন ১৯৯১ সালে। তার পরও ঝামেলা এড়াতে ওই দিনই ১৩ হাজার ২০০ টাকা পরিশোধ করে পান্নু ওয়াসা কর্মকর্তাদের পরামর্শে নতুন করে সংযোগ বিচ্ছিন্নের আবেদন করেন।

দুর্ভোগের এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। তাঁকে এর পর আরও বহু বছর বিল শোধ করতে হয়।

সেই ঘটনার ১০ বছর পর ২০২১ সালের অক্টোবরে আবার ওয়াসা থেকে ১৩ হাজার ৬২৩ টাকার আরও একটি বিল দিয়ে যায়। এই বিল নিয়ে ওয়াসা অফিসে যোগাযোগ করলে এবার কর্মকর্তারা বলেন, আগের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। টাকা পরিশোধ করে সংযোগ বিচ্ছিন্নের আরেকটি আবেদন করেন। সব টাকা পরিশোধ করে ২০২১ সালের নভেম্বরে ওয়াসা অফিসে সংযোগ বিচ্ছিন্নের আবেদন করেন পান্নু।

ভেবেছেন এবার তাঁর দুর্ভোগের অবসান হবে? না, তাও হয়নি। কয়েক দিন আগে আবারও তাঁকে ৯ হাজার ৪৭ টাকার আরেকটি বিল দিয়েছে ওয়াসা। এটা কত বছরের তা উল্লেখ করা নেই। বিলের সঙ্গে যে মিটার নম্বর দিয়েছে তার কোনো অস্তিত্ব নেই, কোনো দিন ছিলও না।

পান্নু সমকালকে বলেন, 'গায়েবি সংযোগ এবং ভুয়া বিল নিয়ে ওয়াসা দপ্তরে অসংখ্যবার গিয়েছি। ওয়াসার কর্মকর্তারা কয়েক দফা বাড়িতে এসেছেন। কেউ সেই সংযোগ খুঁজে পাননি। অথচ প্রতিবছরই তারা বিল দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে প্রায় ৩০ বছর আমাদেরও টাকা দিতে বাধ্য করছে।'

গত ১৪ ডিসেম্বর শেখপাড়ার ওই গ্রাহকের বাড়ির সামনে তাঁর কথা বলার সময় সেখানে উপস্থিত হন শওকত আলী নামে এক বৃদ্ধ। পাশের সরদার নিকেতন ও সরদার প্লাজার কেয়ারটেয়ার তিনি। জানালেন, তাঁরাও পানির বিল নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তাঁদের সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁদের ভবনগুলোতে তিনটি পানির সংযোগ আছে, অথচ কোনো বিল পান না। বিষয়টি অনেকবার ওয়াসা অফিসে জানানো হয়েছে। তার পরও তারা বিল দিচ্ছে না।

জানা গেছে, শেখপাড়া এলাকার অসংখ্য গ্রাহক ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পান্নুর মতো ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। আর নিয়মিত পানির বিল না দেওয়া, ভুল বিল দেওয়া, প্রতি মাসে বিল না দিয়ে কয়েক মাসের বকেয়া বিল জরিমানাসহ একসঙ্গে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ।

গত কয়েক দিন ওয়াসার আঞ্চলিক অফিসগুলো ঘুরে দেখা গেছে, পানির বিলের ভুল সংশোধন ও গায়েবি বিলের সমস্যা নিয়ে প্রতিদিনই ভিড় করেন গ্রাহকরা। কারও সমস্যার সমাধান হয়, বেশিরভাগেই অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করতে হয়। বছরের পর বছর ধরে চলছে এই ভোগান্তি। সহজ সমস্যা রাজস্ব কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক সমাধান করেন। কিন্তু বর্ধিত বিলের সমস্যা সমাধানের জন্য ঘুরতে হয় দিনের পর দিন।

২০০৮ সালে খুলনা ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হয়। খুলনা সিটি করপোরেশনের পানি সরবরাহ বিভাগের পুরোনো প্রায় ৮ হাজার গ্রাহক ওয়াসায় ন্যস্ত হন। বর্তমানে ওয়াসার গ্রাহক প্রায় ৩৯ হাজার। শতভাগ গ্রাহকের পানির বিল মিটারের মাধ্যমে নির্ধারণ হয়। ব্যবহূত ইউনিট অনুযায়ী গ্রাহকদের কাছে বিল পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমির সুলতান লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের।

১৩ ডিসেম্বর ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকার পানির বিলের সমস্যা নিয়ে এসেছেন গ্রাহকরা। নগরীর ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের তালতলা রোডের বাসিন্দা তপন কুমার দাস জানান, প্রতি মাসে তাঁর ২৫০-৩০০ টাকার বিল আসে। কিন্তু নভেম্বরে একসঙ্গে ১ হাজার ১৩৬ টাকা বিল করেছে। অফিসে গিয়ে জানতে পারেন, বিগত কয়েক মাস শূন্য বা ১ ইউনিট করে বিল করেছে। সেটা সমন্বয় করতে নভেম্বরে এক সঙ্গে বেশি বিল করেছে। পরে তাঁকে সংশোধন করে ২৩৮ টাকার বিল দেওয়া হয়েছে।

একই সমস্যা ছিল নগরীর ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বয়রা মসজিদ রোডের বাসিন্দা নেয়ামত উল্লাহর। সমকালকে তিনি বলেন, গত সেপ্টেম্বরে তাঁর বাড়িতে শূন্য ইউনিট বিল করেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ওয়াসা অফিসে অভিযোগ করেন। অক্টোবরেও শূন্য বিল করেছে। তিনি বলেন, আগেও অনেকবার এমন হয়েছে। এক সঙ্গে অনেক টাকার বিল পরিশোধ করতে পারব না। তাই অফিসে গিয়ে বিল ঠিক করে এনেছি। প্রায়ই তারা এমন ভোগান্তিতে ফেলে।

ওয়াসা কর্মচারীরা জানান, কয়েক বছর আগে সমস্যা আরও প্রকট ছিল। তখন প্রতি মাসে হাজারের ওপরে গ্রাহক সমস্যা নিয়ে আসতেন। নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিলের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান সুশীলনকে বাদ দিয়ে ২০২০ সালের মার্চে নতুন কোম্পানি নিয়োগ দেওয়া হয়। সম্প্রতি পানির মিটারের ছবি তোলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সমস্যা কিছুটা কমেছে।

ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক খাদেমুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এখন মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে ছবি তুলে মিটার রিডিং সংগ্রহ করা হয়। সেখানে ভুল হওয়ার সুযোগ কম। মিটার না দেখে শূন্য বিল বা কয়েক মাসের বিল এক সঙ্গে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক বাড়ি তালাবদ্ধ থাকলে মিটার রিডাররা মিটার দেখতে পান না। এসব ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হয়।

বিচ্ছিন্ন সংযোগের বিলের বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ বলেন, ২০১৯ সালে পুরোনো ওই সংযোগ চালু করে দেওয়া হয়েছে। গ্রাহক সেই পানি ব্যবহার করছেন, তাই পানির বিল যাচ্ছে। যেসব গ্রাহকের বিল এতদিন যায়নি, সেগুলোর বিল চলতি মাসেই পেয়ে যাবেন।

তাহলে ৩০ বছর আগের বিল দিতে হলো কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রাহক বলেছেন ১৯৯১ সালে তিনি নিজে নিজে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। এভাবে বিচ্ছিন্ন করার নিয়ম নেই। ২০১১ ও ২০২১ সালের আবেদনও গ্রহণ হয়নি। এ কারণে লেজার বইয়ে গ্রাহকের নাম রয়ে গেছে। সংযোগ সক্রিয় থাকায় বিল গেছে।

তবে ভুক্তভোগী পান্নু সমকালকে বলেন, সংযোগ বিচ্ছিন্নের জন্য তৎকালীন কেসিসির পানি সরবরাহ বিভাগে গেলে তারাই তাঁকে নিজ নিজে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরামর্শ দেন। ২০১১ ও ২০২১ সালে ওয়াসা কর্মকর্তারা লিখিত আবেদন দিতে বলেন। তাঁদের পরামর্শেই সব করেছেন। তার পরও যদি সংযোগ বহাল রাখেন, তাহলে তার দায় কার?

শওকত আলী বলেন, 'চার-পাঁচ বছরের বকেয়া বিল এক সঙ্গে অনেক টাকা আসবে। এত টাকা কীভাবে দেব? ওয়াসার ভুলের দায় আর কতদিন মানুষ ভোগ করবে' -প্রশ্ন দুটি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।