- রাজধানী
- 'চমকহীন' আওয়ামী লীগের কমিটি, তবুও কিছু চমক
'চমকহীন' আওয়ামী লীগের কমিটি, তবুও কিছু চমক

বৈশ্বিক সংকটের কারণে আওয়ামী লীগের এবারের জাতীয় সম্মেলনটি অনেকটাই সাদামাটা হবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, খানিকটা 'নিয়ম রক্ষার' সম্মেলন হবে। গত শনিবার দলটির ২২তম জাতীয় সম্মেলনের কাউন্সিল অধিবেশন থেকে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যদের অনেকগুলো পদ ফাঁকা রেখে যে কমিটি ঘোষিত হয়েছে, তাতে ওই ধারণারই প্রতিফলন ঘটেছে।
সভাপতি পদে শেখ হাসিনা টানা ১০ বার এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদের টানা তৃতীয়বার পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। বেশিরভাগ পুরোনোরাই এসেছেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের নতুন দুই কমিটিতেই। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নতুন কমিটিতে কিছু 'চমক' অবশ্যই রয়েছে।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দলের নেতৃত্বে খুব বেশি পরিবর্তনও আসবে না- এমন কথাও চাউর হয়। ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই হাল ধরবেন। একই সঙ্গে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের একটি আগাম জাতীয় সম্মেলনের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন ওবায়দুল কাদের। এ থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, আওয়ামী লীগের এবারের নতুন কমিটি হবে অনেকটাই 'চমকবিহীন'।
এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের শূন্য পদগুলো পূরণে আজ সোমবার দলের সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক ডাকা হয়েছে। সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শনিবার জাতীয় সম্মেলনের কাউন্সিল অধিবেশনে নতুন কমিটিতে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের ৮১ সদস্যের মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর দুটি, সম্পাদকমণ্ডলীর তিনটি এবং কার্যনির্বাহী সদস্যের ২৮টি পদে কারও নাম ঘোষণা হয়নি। একইভাবে ৫১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের অনেক পদই ফাঁকা রাখা হয়েছে। আজকের সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক থেকে এসব পদে নাম ঘোষণার কথা রয়েছে। ফলে আগের কমিটির যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরা সংশয়ে রয়েছেন।
নতুন কমিটি প্রসঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় সম্মেলনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছেন। পুরোনোরা বেশিরভাগই পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলে অপরিহার্য, তাঁর কোনো বিকল্প নেই। তিনি ৪১ বছর ধরে দলটির সভাপতি। এটা বিশ্বে একটা রেকর্ড। কাউন্সিলরদের চোখের ভাষা ও মনের ভাষা শেখ হাসিনা বোঝেন। সেই অনুযায়ী তিনি নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করেছেন।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদের সিরিয়ালে বড় 'চমক': নতুন কমিটি ঘোষণার বেলায় বড় 'চমক' এসেছে চারটি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে। এই পদে আগের কমিটির চারজনই পুনর্বহাল হলেও তাঁদের সিরিয়ালে রদবদল ঘটিয়ে সংশ্নিষ্টদের ভাবনার কিছুটা 'খোরাক' জুগিয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে বিদায়ী কমিটির তিন নম্বর সিরিয়ালে থাকা ড. হাছান মাহমুদকে এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। বিদায়ী কমিটির এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ দুই নম্বরে চলে গেছেন। এ ছাড়া বিদায়ী কমিটির তিন নম্বরে থাকা ডা. দীপু মনিকে এবার তালিকার সবার শেষে এবং চার নম্বরে থাকা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে তিন নম্বরে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদের সিরিয়ালে এই রদবদল নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় আজকের সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক থেকে তালিকায় কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে বলেও দলের একটি সূত্র জানিয়েছে।
এ ছাড়া নবগঠিত সভাপতিমণ্ডলীতে আগের কমিটির প্রায় সবাই বহাল থাকলেও জ্যেষ্ঠতার সিরিয়ালে কিছুটা রদবদল এনেছেন শেখ হাসিনা। নতুন তালিকায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও নতুন অন্তর্ভুক্ত ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের নাম শাজাহান খান, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমানের ওপরে রাখা হয়েছে।
বাদ ও অন্যত্র স্থান পাওয়ার তালিকায় যাঁরা: ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের তালিকায় যে ৪৮ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বিদায়ী কমিটির ছয়জনের নাম নেই। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১৯ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ পড়েছেন বিদায়ী কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর তিন সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ, রমেশ চন্দ্র সেন ও অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান। অবশ্য এই তিনজনকেই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়েছে।
বিদায়ী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিকও বাদ পড়েছেন। তাঁকে কোথাও রাখা হয়নি। যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক হারুনুর রশীদ এবং শ্রম ও জনশক্তি সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজও নতুন কমিটিতে স্থান পাননি। এই দুই নেতাও উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পেয়েছেন।
ফলে প্রকৃত অর্থে এখন পর্যন্ত বাদ পড়ার তালিকায় রয়েছেন একমাত্র সাখাওয়াত হোসেন শফিক। বিদায়ী কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকাকালে কর্মদক্ষতার ছাপ রাখতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে তিনি বাদ পড়েছেন- এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। অন্যদিকে বয়স ও অসুস্থতাজনিত কারণে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পাঁচ নেতাকে এবার উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হয়েছে।
পদোন্নতিতে 'চমক' জালাল-সুজিত-আমিন: নতুন কমিটিতে পদোন্নতি পেয়ে খানিকটা 'চমক' দেখিয়েছেন তিন নেতা। তাঁদের মধ্যে ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয়েছে। বিদায়ী কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন তিনি। বিদায়ী কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দীকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। নতুন ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হয়েছেন আমিনুল ইসলাম আমিন। বিদায়ী কমিটিতে উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন তিনি। নতুন কমিটির উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে কারও নাম ঘোষণা হয়নি।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসকদের সর্ববৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) বর্তমান সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থেকে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার আস্থায় এসেছেন। ঢাকা-৭ আসনের সাবেক এই এমপিকে তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকায় আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবেও দেখা যেতে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত ঢাকা-৭ আসনের বর্তমান এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম সম্প্রতি দুর্নীতির মামলায় জেল খেটেছেন। নানা অপকর্মে বিতর্কিত হওয়া এই এমপিকে বাদ দিয়ে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী করার গুঞ্জন রয়েছে।
অন্যদিকে সুজিত রায় নন্দী বিদায়ী কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে থাকাকালে দলের পক্ষে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে আলোচনায় ছিলেন। বিশেষ করে করোনা সংকট এবং সিডরসহ সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোতে তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রীসহ নগদ অর্থ বিতরণ কার্যক্রমকে প্রশংসার চোখে দেখা হচ্ছে। এ কারণেই তাঁকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে বিদায়ী উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনকে পূর্ণ সম্পাদক করে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
উপদেষ্টা পরিষদের 'চমক' খন্দকার মোশাররফের বাদ পড়া: আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাদ পড়াকেও 'কিছুটা চমক' হিসেবে দেখা হচ্ছে। দুই দফায় আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এবং বর্তমান মেয়াদসহ টানা তিন দফায় ফরিদপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য অনেক আগে থেকেই বিতর্কিত হয়ে পড়েছিলেন।
দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৫১ জন। তবে দলের সভাপতি চাইলে এই সংখ্যা বাড়াতে পারেন। এবার খন্দকার মোশাররফ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদ থেকে আর কেউ বাদ পড়েননি। উপদেষ্টা পরিষদে আরও বেশ কয়েকটি পদ ফাঁকা রয়েছে। ২০১৯ সালের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের পর করোনায় উপদেষ্টা পরিষদের বেশ কয়েকজন নেতা মারা যান। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- আবুল মাল আবদুল মুহিত, রহমত আলী, এইচ টি ইমাম, অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন আহমেদ, মকবুল হোসেন, অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার, মুকুল বোস, জয়নাল হাজারী ও আবুল হাসনাত। আজকের সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক থেকে উপদেষ্টা পরিষদের শূন্য পদগুলো পূরণের সিদ্ধান্তও আসতে পারে।
মন্তব্য করুন