- রাজধানী
- শিশুর হৃদরোগ
শিশুর হৃদরোগ

শিশুদের হৃদরোগ আর বড়দের হৃদরোগের কারণ, উপসর্গ সবকিছুই যেমন একটু ভিন্নতর, তেমনি চিকিৎসার ধরনও আলাদা। অধিকাংশ সময় বড়দের হৃদরোগ ওষুধ দিয়েই প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। অন্যদিকে, শিশুদের জন্মগত হৃদরোগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হয়
শিশুদের হৃদরোগ আর বড়দের হৃদরোগের কারণ, উপসর্গ সবকিছুই যেমন একটু ভিন্নতর, তেমনি চিকিৎসার ধরনও আলাদা। অধিকাংশ সময় বড়দের হৃদরোগ ওষুধ দিয়েই প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। অন্যদিকে, শিশুদের জন্মগত হৃদরোগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এত অল্প বয়সে অপারেশন করবেন? স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তো রয়েছেই। উপরন্তু মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনের দুর্ভাবনা। তার পরও উন্নত দেশে আধুনিক ব্যবস্থাপনার কারণে চিকিৎসকরা অনেকটা সফলভাবেই শিশুদের হৃদরোগের শল্যচিকিৎসা করে থাকেন। আমাদের দেশেও শিশুদের জন্মগত হৃদরোগ যেমন এএসডি, ভিএসডি, পিডিএ, টিজিএ, টফ- এসব রোগের শল্যচিকিৎসা রয়েছে। তবে যে কোনো হৃদরোগের সার্জারির পৃথিবীময় মৃত্যুঝুঁকি থাকেই।
এসব দিক বিবেচনায় রেখেই বিজ্ঞানের কল্যাণে শিশুদের হৃদরোগ চিকিৎসায় বুক না কেটেই হার্টের নানা অসংগতির অভিনব চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। হার্টের অলিন্দ বা নিলয়ের ছিদ্র (এএসডি বা ভিএসডি), জন্মগত বাড়তি নালি (পিডিএ), রক্তনালি সংকুচিত অংশ অথবা ভাল্ভের সংকুচিত সঙ্গমস্থল- এসব কিছুর চিকিৎসার আজকাল আর সার্জনের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। অথবা এমন কোনো হৃদরোগের চিকিৎসা রয়েছে, যেখানে সার্জন এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ উভয়ের তত্ত্বাবধানে জন্মগত হৃদরোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন- টফের অপারেশনে যে অংশে ভাল্ভের সংকুচিত অবস্থা রয়েছে, তা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরাই বেলুন চিকিৎসার মাধ্যমে করে থাকেন। হার্টের ছিদ্র মেরামতসহ অন্যান্য শল্যচিকিৎসার অংশটি সার্জনরাই উন্নত দেশগুলোয় করে থাকেন। এ ধরনের হৃদরোগ চিকিৎসার অভিনব ব্যবস্থাপনাকে বলা হয়, 'হাইব্রিড প্রটোকল'।
এসব ক্ষেত্রে বুক না কেটেই পুরোপুরি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। জন্মগত হৃদরোগীদের আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। এর বহু কারণ রয়েছে। প্রথমত, শিশু হৃদরোগ চিকিৎসকরা ধারণা করেন, হয়তো জন্মগত ত্রুটি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনাআপনি ঠিক হয়ে যাবে। সাধারণত ইকো কার্ডিওগ্রাম পরীক্ষা এবং বিশেষ ক্ষেত্রে এনজিওগ্রাম করেই চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন শিশুর ঠিক কী ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন। আবার অনেক ক্ষেত্রে শিশুর অবস্থা এতই নাজুক থাকে অথবা বয়সটা এতই কম, অপারেশন করা আমাদের দেশের আলোকে সম্ভব নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ দিয়ে রোগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, যেন মা-বাবা উপযুক্ত সময় তাঁর শিশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে একটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে, শিশুর বয়স বা ওজন দিয়ে শিশুদের হৃদরোগ সার্জারি নির্ধারিত হয় না। জীবন রক্ষার তাগিদে প্রয়োজনে এক দিনের বাচ্চারও অপারেশন অথবা বুক না কেটে ইন্টারভেনশন বা ডিভাইস চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যেমন ধরুন, এক দিনের একটি শিশু যে টিজিএ রোগের শিকার, তার জন্মের প্রথম সপ্তাহেই 'সেপ্টোস্টমি' জাতীয় চিকিৎসার প্রয়োজন। নতুবা সে মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে থাকবেই। এ অবস্থায় বুক না কেটেই শিশুটিকে এ ধরনের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। আবার ধরুন, কোনো শিশুর মহাধমনির উপরিভাগ জন্মগতভাবে সংকুচিত হয়ে আছে এবং এই শিশুটির
জন্মগতভাবে বাড়তি নালি ভাক্টাস আর্টারিওসাস অক্ষুণ্ণ আছে। এ অবস্থায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা ওই বাড়তি নালিটির মধ্যে স্টেন্ট বা রিং বসিয়ে শিশুটিকে সুস্থ রাখতে পারেন। এভাবে কোনো শিশুর যদি জন্মগতভাবে অলিন্দের বা নিলয়ের (ভেন্ট্রিকল) পর্দায় ছিদ্র থাকে, এমপ্লাঞ্জার বা বাটন ডিভাইস কিংবা প্রযুক্তির মাধ্যমে তা বন্ধ করা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে ছিদ্রের মাপ বেশি বড় হয়ে গেলে বা পাশাপাশি ভাল্ভের সমস্যা থাকলে ডিভাইস পদ্ধতি কার্যকর নাও হতে পারে। পিডিএ বা বাড়তি রক্তনালির কারণে যখন হার্ট ফেইলিউরের ঝুঁকি থাকে, তখন জন্মের প্রথম দিনগুলোতেই ওষুধ দিয়ে অথবা পরে বুক না কেটে অকলুগর ডিভাইস পদ্ধতিতে শিশুর নিরাপদ চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। আবার এই বাড়তি রক্তনালিটি যখন শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় মনে হবে, তখন জন্মের প্রথম দিনগুলোতে ওষুধের মাধ্যমেই নালিটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। শুধু জন্মগত হৃদরোগেই নয়, রিউমেটিক ভাল্ভের রোগীদের ভাল্ভ রোগের কারণে সংকুচিত হয়ে গেলে বেলুনের সাহায্যে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।
শিশুদের হৃদরোগ অনেকের কাছেই বিস্ময়ের ব্যাপার। আর যখন পরিবারের কোনো সদস্য এ ধরনের রোগের শিকার হয়, তখন দুর্ভাবনার সীমা থাকে না। বিশেষ করে চিকিৎসক যখন জানান, শিশুটির জরুরি সার্জারি প্রয়োজন তখন আত্মীয়স্বজন মুষড়ে পড়েন। শিশুদের বুক না কেটে এ ধরনের অভিনব হৃদরোগের চিকিৎসা আমাদের দেশে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটসহ বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন বিএসএমএমইউ, হার্ট ফাউন্ডেশন, সিএমএইচ, শিশু হাসপাতাল ও ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে দেওয়া সম্ভব। া
[অধ্যাপক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল]
মন্তব্য করুন