ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুসারী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আবারও সংবাদের শিরোনামে উঠিয়া আসিয়াছে; তবে দুঃখজনক, কোনো ইতিবাচক কর্মের জন্য নহে। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি শিরোনামভুক্ত হইয়াছে উহার কতিপয় নেতাকর্মীর অপকর্মের কারণে। শুক্রবার সমকালে এই বিষয়ে দুইটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হইয়াছে। একটায় লিখা হইয়াছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দাবি মানিয়া চাঁদা না দেওয়ায় গত মঙ্গলবার রাতে তাহার অনুসারীরা বঙ্গবাজারের এক পানি ব্যবসায়ীর দোকানে হামলা চালাইয়াছে।

অপর প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে- রাবি বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে প্রশাসনের বরাদ্দকৃত সিটে ছাত্রলীগ নেতার বাধায় থাকিতে না পারিয়া গত বুধবার রাতে উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী শয্যাপত্র লইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের প্রবেশপথে অবস্থান গ্রহণ করেন। অবশ্য প্রথম ঘটনায় ভুক্তভোগী কোনো প্রতিকার পাইয়াছেন কিনা, উহা প্রতিবেদন হইতে জানা না গেলেও দ্বিতীয় ঘটনায় ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় তাঁহার স্বীয় সিটে গত বৃহস্পতিবার শয্যা পাতিয়াছেন বলিয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হইয়াছে। তবে উক্ত প্রতিবেদনে সংশ্নিষ্ট শিক্ষার্থীর এই শঙ্কাও প্রকাশিত হইয়াছে- কতদিন তিনি ঐ সিটে নিরুপদ্রব থাকিতে পারিবেন, উহা লইয়া তাঁহার বিস্তর সংশয়। এই প্রসঙ্গে আমরা গত বৎসরের ২৮ জুন সমকালেই প্রকাশিত '১১ আবাসিক হলে ছাত্রলীগই রাজা' শিরোনামের প্রতিবেদনটি স্মরণ করিতে পারি। তথায় বলা হইয়াছিল- রাবির ছাত্র হলগুলিতে প্রশাসনিক 'ক্ষমতা' প্রাধ্যক্ষদের হস্তে থাকিলেও ছাত্রলীগই ছায়া প্রশাসন; হলগুলিতে সিট বরাদ্দ দেয় ছাত্রলীগ; অধিকাংশ হলে প্রাধ্যক্ষরা ছাত্রলীগের এহেন ধারাবাহিক অপকর্ম নীরবে মানিয়া চলিয়াছেন।

আলোচ্য ঘটনায়ও কিন্তু ভুক্তভোগী হল প্রশাসনের নিকট হইতে কোনো প্রতিকার না পাইয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের প্রবেশপথ আটকাইয়া দেন। আর অমর একুশে হলের ছাত্রলীগ নেতাদের পার্শ্ববর্তী মার্কেটগুলি হইতে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের অভিযোগও নূতন নহে; কখনও কখনও অতিরিক্ত চাঁদা না পাইয়া সংশ্নিষ্ট ব্যবসায়ীকে তুলিয়া আনিয়া নির্যাতনের অভিযোগও উক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে বহু প্রাচীন।

শুধু কি হলের সিট দখল বা ব্যবসায়ীদের নিকট চাঁদা দাবি? সরকার সমর্থক এই ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হইবার অব্যবহিত পরই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ নানা বিরুদ্ধমতের ছাত্র সংগঠনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গন হইতে জোরপূর্বক বিতাড়িত করিবার অভিযোগ ওঠে, যাহা অদ্যাবধি বহাল। তৎসহিত দৃশ্যমান এই সংগঠনের নেতাকর্মীকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত হইতে।

ছিনতাই, অপহরণ, নারী শিক্ষার্থীর ওপর যৌন নির্যাতন চালানো, এমনকি জঘন্য অপরাধ ধর্ষণ সংঘটনের বিস্তর অভিযোগও উহাদের বিরুদ্ধে রহিয়াছে। এহেন অপকর্ম লইয়া অদ্যাবধি এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে কতবার যে লিখা হইয়াছে, তাহারও কোনো ইয়ত্তা নাই। এত কিছুর পরও দুর্ভাগ্যজনক, দেশের অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটির সংশোধিত হইবার কোনো আলামত দৃশ্যমান নহে। কোনো কোনো ঘটনায় বিশেষত সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সংশ্নিষ্ট অভিযুক্ত নেতা বা কর্মীকে সংগঠন হইতে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বটে; কিন্তু দেখা গিয়াছে; সমালোচনা থামিয়া গেলেই ঐ বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহূত হয় এবং ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তি পুনরায় একই অপকর্মে লিপ্ত হয়।

সরকারপ্রধানকেও- যিনি সংগঠনটির সাংগঠনিক নেত্রীও বটেন; আমরা মাঝে মাঝে ছাত্রলীগের আদর্শচ্যুত নেতাকর্মীর উদ্দেশে শক্ত সতর্কবার্তা জারি করিতে দেখি। এতদসত্ত্বেও অপরাধে লিপ্ত সংগঠনটির সদস্যদের অপকর্ম চালাইয়া যাইতে কোনো বিঘ্ন ঘটিতে দেখা যায় না।

সংগঠনটির দুর্বৃত্ত সদস্যরা এমন বল্কগ্দাহীন থাকিলে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রভূত অবদান রাখা ছাত্রলীগ হয়তো ক্ষমতাসীনদের এক প্রকার লাঠিয়াল হিসেবে টিকিয়া থাকিবে বটে, কিন্তু ছাত্রসমাজের মধ্যে উহার কোনো অবস্থান থাকিবে না। ফলস্বরূপ শাসক দলটি রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। অতএব, এখনই সময় সরকার ও সংগঠনটির সুনাম ক্ষুণ্ণকারী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের।