রাজনীতিবিদদের জন্য মানুষের আস্থা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে সবকিছু ঠিক থাকলেও মানুষের মধ্যে এই আস্থা না থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। রাজনীতিবিদদের বিষয়টি বোঝা উচিত। গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে আয়োজিত আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কৌশিক বসু।

অনুষ্ঠানে ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিক বসু অর্থনৈতিক উন্নয়নের গবেষণা, নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের নানা প্রসঙ্গে কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে 'উন্নয়ননীতির আলোচনায় অধ্যাপক কৌশিক বসু' শীর্ষক অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে বাঙলার পাঠশালা। দুটি প্যানেল আলোচনার প্রথমটিতে সভাপতিত্ব করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। আলোচনায় আরও অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরি, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাঙলার পাঠশালার সভাপতি আহমেদ জাভেদ।

অধ্যাপক কৌশিক বসু বলেন, রাজনৈতিক শক্তির জন্য মানুষের আস্থা অর্জন খুবই প্রয়োজন। উদাহরণ দিতে গিয়ে একটি দেশের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন. ওই দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হঠাৎ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবৃদ্ধি কমার কোনো কারণই ছিল না। পরে জানা গেল, সেখানে রাজনৈতিক শক্তির প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে।

অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কৌশিক বসু বলেন, কভিড-১৯ অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত। সংস্কারের উদ্যোগও ইতিবাচক। বাংলাদেশ ঠিক সময়েই আইএমএফের কাছে গিয়েছে, তা না হলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারত।

তিনি বলেন, ভারতও ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রভাবে দেখা দেওয়া সংকট মোকাবিলায় আইএমফের দ্বারস্থ হয়েছিল। বাংলাদেশের এখন তো প্রায় পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ আছে। ভারতের তখন মাত্র ১৩ দিনের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ ছিল। যে কোনো সংকট সুযোগও তৈরি করে- মন্তব্য করে তিনি বলেন, দু'বছরে ভারত সেই সংকট কাটিয়ে ওঠার পর আইএমএফকে বলেছিল- আর সহায়তা দরকার নেই। বাংলাদেশও সেই পথে হাঁটতে পারে বলে মত দেন তিনি। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন তিনি। কৌশিক বসু বলেন. বাংলাদেশের জন্য এখন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আরও উন্নয়ন দরকার। এ দুটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, উন্নয়নের জন্য অবশ্যই সঠিক পরিকল্পনা দরকার। সরকারের ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ৮৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে জানান তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। শুধু একটা দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ফিরে যায় বাংলাদেশ। প্রণয়ন করা হয়ছ দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্পও। এতে দেশে পরিকল্পিত উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা আরও বাড়ানোর দরকার বলে এ সময় মত দেন তিনি।

নিজের কিছু অভিজ্ঞতার আলোকে ড. আতিউর রহমান বলেন, নীতিনির্ধারণ খুবই কঠিন প্রক্রিয়া। এ নিয়ে কাজ করতে গেলে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। সহ্য করতে হয় অনেক কিছু। মূল্যস্ম্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ। অথচ মাঝে কিছুদিন সেটি সরকার ঠিক করে দিত। আপত্তি জানানোর পর তা পরিবর্তন করা হয়েছে। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সাফল্যের কথাও উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিভিন্ন সাফল্যের পেছনে সামাজিক সূচকের অগ্রগতি ভূমিকা রেখেছে বলে মত দেন ড. এম কে মুজেরি। এ ছাড়া তিনি বলেন, উন্নয়ন গবেষক, নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে দূরত্ব থাকে। এ কারণে বাস্তবায়ন কাজের সুফল বাধগ্রস্ত হয়। আমলারা অনেক সময় বড় পরিবর্তনের ঝুঁকি নিতে চান না। নীতিনির্ধারকদের উচিত বাস্তবতার নিরিখে এ সম্পর্কিত দূরত্ব কমিয়ে আনা।