- রাজধানী
- ভুল তথ্য নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে যাবে না
সাক্ষাৎকার: ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী
ভুল তথ্য নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে যাবে না

ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭৮ সালে কর্মজীবন শুরু করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে ফেলোশিপ করেছেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক, ১৯৭৮ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৮৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়া থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি। মনজুর আহমেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৫২ সালে, মাদারীপুরে।
সমকাল: নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে ৩৭ হাজারের বেশি নদনদী দখলদারের নাম মুছে ফেলার অভিযোগ উঠেছে।
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: নতুন দখলদারদের তালিকা আমরা বুঝে পেয়েছি ২৮ ডিসেম্বর। দুই সপ্তাহের মধ্যে মুছে ফেলার অভিযোগ নিয়ে আসা হলো! এটা কি সম্ভব? দুই সপ্তাহের মধ্যে এত ডাটা মুছে ফেলা! আমাদের তো আরও কাজ আছে। ড্রাইডক উদ্ধার করেছি; আরও দখলদার আছে; অভিযানের স্বার্থে তা প্রকাশ করছি না। এখান থেকে সরিয়ে আনার জন্য এসব করা হচ্ছে।
সমকাল: তালিকা নিয়ে আসলে কী ঘটেছে?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: সংবাদমাধ্যমে আমি একাধিকবার বলেছি- ওয়েবসাইটে তালিকা প্রকাশ ও মুছে ফেলার অভিযোগটি অমূলক। আবারও বলি, কোনো ডাটা মুছে ফেলা হয়নি। মুছে ফেলার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আপলোড না করা আর ডিলিট করার মধ্যে পার্থক্য না বুঝে কেউ কেউ বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। তালিকার প্রায় ৩৫০ কপি জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সুতরাং এগুলো যাচাই-বাছাই হয়ে আসবে। এগুলো আমাদের ওয়েবসাইটে আছে। পাসওয়ার্ড ছাড়া দেখা যাবে না। আমরা এগুলো তখনই পাবলিক করে দেব, যখন যাচাই-বাছাই হয়ে চূড়ান্ত হয়ে আসবে। যদি মাঠ প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা কোনো সংশোধনী দেন, সেটা সংশোধন করে সঠিকটি দেওয়া হবে।
সমকাল: নতুন দখলদারদের আগে যে তালিকা ছিল, সেটার সঙ্গে যোগ হবে?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: কমবেশি ৫৭ হাজার যে দখলদার আছে, সে তালিকার সঙ্গে এটি যোগ হবে। ৩৭ হাজার দখলদার- এটা কমবেশি হতে পারে। তারা তালিকা দিয়েছে, আমরা যাচাই-বাছাই না করে সংখ্যা বলতে পারব না। সঠিক তথ্য ও সংখ্যাই আমরা জনসমক্ষে প্রকাশ করব। যতই চাপ সৃষ্টি করা হোক, ভুল ও বিভ্রান্তিকর কোনো তথ্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে যাবে না। যাওয়া উচিতও নয়।
সমকাল: ওয়েবসাইটে তালিকা প্রকাশের পর কোনো চাপ এসেছিল?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: অন্যদের কথা শুনে প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না। আমি বারবার বলছি- তালিকা প্রকাশই করা হয়নি। তাহলে মোছার বিষয়ে কেন প্রশ্ন আসছে? আর আমরা চাপে আছি- এ অভিযোগ কে করছেন? বালুখেকোর বিরুদ্ধে যাওয়ায় আমার বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকার মামলাও করা হয়েছে। ড্রাইডক আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা কোনো চাপে নেই। এসব প্রশ্ন তুলে আপনারা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে বিতর্কিত করে ফেলছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও বিতর্কিত করে ফেলছেন।
সমকাল: আপনাকে বিতির্কিত করে কী লাভ?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: আপনারা সাংবাদিক, আপনারা এসব বোঝেন না? খুঁজে বের করুন কারা আমাদের বিতর্কিত করতে চায়, কেন চায়। তার বদলে আপনারা আমার কাছে আসেন ডাটা চেক করতে! আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি- জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে কোনো দুর্নীতি, অনিয়মের লেশমাত্র নেই। কেউ প্রমাণ করতে পারলে আমরা মাফ চেয়ে বিদায় নেব। আমরা হীরকের মতো স্বচ্ছ, আবার হীরকের মতো শক্ত।
সমকাল: জেলা প্রশাসকদের তালিকাটি যাচাই-বাছাই করতে কত দিন লাগতে পারে?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: জেলা প্রশাসকদের কাছে গিয়ে প্রশ্নটি করুন। আমরা তাঁদেরকে তালিকা দিয়েছি, ফোনেও বলা হচ্ছে। তিনটি নদীর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আমরা পেয়েছি। অনেক নদীর অসম্পন্ন প্রতিবেদন পেয়েছি। জেলা প্রশাসকদের এসব কাজের সময় বেঁধে দেওয়া যায় না। তাঁরা অনেক ব্যস্ত লোক। ৫৭ হাজার দখলদারের সবাইকে আমরা এখনও উচ্ছেদ করতে পারিনি। উচ্ছেদ একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা ২৩ শতাংশ দখলদার উচ্ছেদ করেছি। সংখ্যার হিসাবে এটি ১৩ হাজারের মতো। তালিকা করার আগে যে উচ্ছেদ হয়নি, এমন নয়। আগেও উচ্ছেদ হয়েছে।
সমকাল: তার মানে, জেলা প্রশাসকরা প্রতিবেদন না দেওয়া পর্যন্ত আপনারা দখলদারদের তালিকা আমলে নিতে পারছেন না?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: জমির ব্যাপারে আইনগতভাবে কথা বলার এখতিয়ার জেলা প্রশাসকের। ডিসির অনেক ভূমিকা আছে। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা কালেক্টর। কালেক্টর হিসেবে তিনি জমির রক্ষক, ব্যবস্থাপক, ট্রাস্টি। এককথায়, জমির বিষয়ে তিনিই মুখ্য ব্যক্তি। তাঁর সার্টিফিকেট ছাড়া কাউকে অবৈধ বলা যাবে না; বৈধও বলা যাবে না। হাইকোর্ট যেভাবে বলেছেন, আমরা সেভাবেই কাজ করছি। নদী থেকে তীরবর্তী ১০ মিটার পানি আইন অনুযায়ী নদীর মালিকানাধীন। এখন নদীভাঙনের ফলে যাঁর সম্পত্তি নদী গ্রাস করেছে, বাকি অর্ধেক জমিতে তিনি বাস করছেন। তাঁকে কি দখলদার বলার সুযোগ আছে? বাংলাদেশের কোন আইনে তাঁকে দখলদার বলবেন? পানি আইন অনুযায়ী তিনি তো দখলদার। অথচ জমির সব রেকর্ড আছে তাঁর। তিনি অর্ধেক জমি হারিয়ে দিশেহারা। এ অবস্থায় তাঁকে উচ্ছেদ করতে গেলে সরকারি কর্মকর্তাদের পরিণতি কী হবে, তা তো বোঝেনই। আবার অন্যভাবে চিন্তা করুন, নদীতে চর জাগলে সেটি সরকারের সম্পত্তি। পানি আইন অনুযায়ী নদী থেকে ১০ মিটার যদি নদীর মালিকানাধীন হয়; বাকিটা কার? এসব বিষয়ে কালেক্টর সিদ্ধান্ত দেবেন।
সমকাল: নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক একজন চেয়ারম্যান তালিকা বাতিলের সমালোচনা করে এটিকে দখলদারদের পক্ষে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন।
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: তাঁর সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। তিনি প্রতিনিয়ত নানাবিধ কথা বলছেন। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি অবসর নিয়েছেন। আমি শুনেছি, তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালীন তিন বছর প্রতিদিন নদী, আরএস, সিএস নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিতেন। তাঁর পরে এবং আমার আগে আরেকজন চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু এখন কেন তিনি কমিশন নিয়ে এসব মন্তব্য করছেন, আমি জানি না।
সমকাল: আপনারা বলছেন, প্রকল্পটিতে ৩৯টি ত্রুটি ছিল। প্রধান প্রধান কী?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: সার্চ অপশন নেই। যে লোক এটি করেছেন, ডাটাবেজ সম্পর্কে তাঁর ধারণাই ছিল না। একটি হাতুড়ে টাইপের লোক। এখান থেকে প্রিন্ট করা যায় না। ডাটাবেজে ব্যাক করার কোনো কায়দা নেই। বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞকে ডাটাবেজটি দেখানো হয়েছে। তাঁরা এটিতে ৩৯টি ত্রুটি পেয়েছেন। এখনও ৩২টি মেজর ত্রুটি রয়ে গেছে। ডাটাবেজের হার্ডকপি এবং সফ্ট কপির মধ্যে একটু নয়, অনেক ফারাক। তাঁরা যে দুটি ফরমে ডাটা সংগ্রহ করেছেন, একটি ফরমের ডাটা এন্ট্রিই করেননি। প্রকল্পে অনেক রকম জটিলতা ছিল। সে জন্যই আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। জাতির সামনে তুলে ধরার আগে আমরা দেখছি এসব তথ্য সঠিক কিনা।
সমকাল :প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ৪ বছরে সময়, অর্থ ও জনশক্তি ব্যয় হয়েছে। এর দায় কে নেবে?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: প্রথমত, এর দায় আমি অন্য কারও ওপর চাপিয়ে দেব না। প্রায় এক বছর ধরে আমি চেয়ারম্যান আছি। কমিশনের প্রধান হিসেবে দায় আমারই। কিন্তু এ বিষয়টিও আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে; চার বছর আগে আমি দায়িত্বে ছিলাম না। আগের চেয়ারম্যান করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার আগে চেয়ারম্যান ছিলেন মুজিবুর রহমান হাওলাদার। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হয়েছে। চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলে ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত হয়। তবে হ্যাঁ, কাজে গতি কম ছিল। আবার আমি এসেও প্রকল্পের মেয়াদ ৬ মাস বাড়িয়েছি। না হলে শেষ হচ্ছিল না।
সমকাল: দখলদারের তালিকায় আপনার আত্মীয়স্বজনের নাম আসার অভিযোগ এসেছে।
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: নদীর দুই পাড়ে হাজার হাজার মাইলজুড়ে আমার নাকি আত্মীয়স্বজন আছে। আড়িয়ালখাঁর দুই তীরে আমার আত্মীয়স্বজন, মধুমতীর দুই তীরে আমার আত্মীয়স্বজন। এত আত্মীয়স্বজন থাকলে আমি তো একটি রাজনৈতিক দল বানাতে পারতাম।
সমকাল: তালিকা নিয়ে অভিযোগ তোলায় পরিবেশবাদীদের প্রতি আপনি ক্ষুব্ধ কেন? প্রশ্ন তোলা যাবে না?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: প্রশ্ন তুলতে কোনো মানা নেই; কখনোই নেই। দেশে অনেক পরিবেশবাদী আছেন, সবার সঙ্গে কি আমার সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে? কিছু লোক, যাঁদের গবেষণা বা পরিবেশ বিষয়ে একাডেমিক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা নেই; যাঁরা ইকোলজি, ইকোসিস্টেম বোঝেন না, তাঁরা প্রশ্ন তুললে কী দাঁড়ায়? দেখুন, পরিবেশবিদ আর অ্যাক্টিভিস্ট আলাদা বিষয়। অ্যাক্টিভিজম যে কেউ শুরু করে দিতে পারেন। অ্যাক্টিভিস্টদের আমি অভিনন্দন জানাই; তাঁরা ভালো কাজ করছেন। কিন্তু তাঁরা যখন গবেষণা পদ্ধতি না জেনে নদী মাপজোখ শুরু করেন, তখন মিসগাইডেড হন। এগুলো করে তাঁরা জনগণের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেন। পরিবেশ নিয়ে যে কেউ কথা বলতে পারেন। কারণ তাঁদের মানবাধিকার আছে, বাকস্বাধীনতা আছে; কিন্তু আমরা সেটাকে বিবেচনায় নিই না। যাঁরা বিশেষজ্ঞ তাঁদের কাছ থেকে আমরা মতামত নিই।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: সমকালের জন্য শুভকামনা।
মন্তব্য করুন