
এটা ঠিক, ফেব্রুয়ারি এলে আমরা বাংলা ভাষার জন্য আবেগে কাঁপতে থাকি। এই আবেগ অত্যন্ত সৎ এবং এই আবেগ না থাকলে কোনো জাতিই সভ্য হতে পারে না। কিন্তু সত্যিই কি আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার কদর এমনভাবে থাকবে? বিশেষ করে ভারতে? এ প্রশ্নের সামনে এসে হকচকিত হয়ে যাই। কারণ একটু খোলা চোখে দেখলেই সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগে।
এটা ঠিক, বিশ্বায়নের যুগে ভাষা বাঁচিয়ে রাখা সহজ কথা নয়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ সালে সারাবিশ্বে প্রায় সাত হাজার ভাষা ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমানে কথ্য ভাষাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিশ্বে বাংলা ভাষার স্থান পঞ্চম; ভারত-বাংলাদেশের নাগরিক এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসী মিলিয়ে বাংলাভাষীর সংখ্যা ৩০ কোটির বেশি। তারপরও বাংলা ভাষা যে সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে, তা বলা বাহুল্য। বিশেষত ভারতে। ভারতে ২২টি জাতীয় ভাষার মধ্যে একটি বাংলা ভাষা হলেও, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্যেই তার অবস্থা বিপন্ন।
ভাষার বিলুপ্তি সম্পর্কে প্রথম সচেতন করে দিয়েছিলেন আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিষয়ক গবেষক মাইকেল ক্লাউস। তিনি ২০০৭ সালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলেন, আগামী ১০০ বছর যে ভাষা দৈনন্দিন কাজে বা মানুষের মুখে ব্যবহূত হবে, সেই ভাষাই হলো নিরাপদ ভাষা। বাংলা ভাষা সেই তুলনায় কতটা নিরাপদ, এখন তা বিচার্য।
বর্তমানে ভারতবর্ষের যে অংশটিকে আমরা ঝাড়খণ্ড নামে চিনি, এটি আগে ছিল গৌড় বঙ্গ বা বৃহৎ বঙ্গের অংশ। বাংলার সংস্কৃতি, বাংলা ভাষাও ছিল তাদের নিজস্ব। ভাষাতত্ত্ববিদ সুকুমার সেন বাংলা উপভাষাকে যে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন, সেখানে একটি ঝাড়খণ্ডী উপভাষা। ঝাড়খণ্ডের জনগণের একটা বড় অংশ বাংলায় কথা বলে, লেখালেখি করে, ভাবে। ঝাড়খণ্ডে বিভিন্ন সময়ে বহু সাহিত্য রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। নিজেকে বাঙালি ভেবে মানভূম বিদ্রোহে অনেকে নাম লিখিয়েছেন। শহীদ হয়েছেন। এ অঞ্চলের মানুষ বাংলা ভাষার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বিদ্রোহে নেমেছে, বাংলা ভাষাকে নিজের ভাষা করে রাখতে চেয়েছে। প্রথমে পুরুলিয়া থেকে ভাগ করে এই বিরাট বাংলাভাষী অঞ্চলটিকে ঢোকানো হয়েছে বিহার প্রদেশে। তারপর ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে বিহার প্রদেশ থেকে খণ্ডিত হয়েছে ঝাড়খণ্ড রাজ্য। জনজাতি তখন আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে নিজস্ব আবেগ, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে। কিন্তু ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সব স্বপ্ন দিবাস্বপ্নে পরিণত হতে সময় নিয়েছে মাত্র ১০ বছর।
বিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকাকালীনও বাংলা ভাষাভাষী প্রধান অঞ্চলে বাংলা পাঠ্যপুস্তক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষামাধ্যম বাংলা ছিল। বাংলা শিক্ষকের নিযুক্তি হতো। কিন্তু এখন স্কুলে বাংলা বই পাওয়াই যায় না। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোকে পাল্টে ফেলে জায়গা দখল করে নিয়েছে হিন্দি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা না থাকার ফলে ছাত্রছাত্রীদের বাংলা ভাষা শিক্ষা হচ্ছে না। অথচ তারা বাড়িতে বাংলাতেই কথা বলে, ভাবে, স্বপ্ন দেখে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ছাত্রছাত্রী নেই বলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বাংলা বিভাগ। ভাষা শেখা অবশ্যই দরকার। তাই বলে নিজস্ব ভাষাকে ধ্বংস করে নয়!
পরম্পরাগতভাবে চলে আসা এই বাংলা ভাষাতেই ঝাড়খণ্ডের মূল লোকসাহিত্য 'টুসুগান' রচিত। যেটি আমাদের ঝাড়খণ্ডকে চিনতে সাহায্য করে। এখানকার পরব করম, টুসু পূজা, ভাদু ইত্যাদি লোকসংগীত রচিত বাংলার আঞ্চলিক ভাষায়। এই আঞ্চলিক বাংলার হরফ হচ্ছে বাংলা লিপি।
এখানকার বিরাট জনজাতি নিজেদের মধ্যে ঝাড়খণ্ডী বাংলা উপভাষায় কথা বলে এবং নিজেদের বাঙালি বলে ভাবে। ঝাড়খণ্ডের মূল সংস্কৃতি ছিল বাংলাকেন্দ্রিক। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল। এ অঞ্চলের ঝুমুর, ভাদু, টুসুগান, মনসামঙ্গল, বাউল, ছৌ নাচ, ষষ্ঠী গান, ঝাঁপান গান জাতীয় সম্পদ। কিন্তু এগুলো আজ বাংলা ভাষা ও লিপির অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। দীর্ঘদিন ধরে কোনো বাংলা শিক্ষক-অধ্যাপক নিযুক্ত হননি এ রাজ্যে। গত ১০-১৫ বছরে বাংলা ভাষা শিক্ষার্থীর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলা পাঠ্যপুস্তক ছাপানো। বাংলা পড়তে উৎসাহী ছাত্রছাত্রীরা কোনো বাংলা বই পাচ্ছে না। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলো রূপান্তরিত হয়েছে হিন্দি মাধ্যমে। প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষক নেই, পাঠ্যপুস্তক নেই। স্কুল নেই। বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলো হিন্দি মাধ্যমে রূপান্তর করার পন্থা চালু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
ঝাড়খণ্ডে বাংলা ভাষার এই দুরবস্থার জন্য সেখানকার বাঙালিরাও কম দায়ী নয়। মানভূম অঞ্চল যে ভাষায় জন্য আন্দোলনে নেমেছিল, সেই আন্দোলন এখন আর দেখা যায় না। বাঙালিরাই তাদের শিশুদের পাঠাচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে।
ঝাড়খণ্ড রাজ্যটির বাংলা ভাষাভাষীরা যেন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। ঝাড়খণ্ড থেকে বাংলা ভাষাকে অবলুপ্ত করে দেওয়া মানে ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতিকেও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলা। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার পঞ্চম স্থানটিও খুইয়ে ফেলা। সমাজের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা কিংবা বিশ্বায়নের যুগে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইংরেজি, হিন্দি ভাষা শেখাটিও অবশ্যই জরুরি। ভাষা দিবস মানে প্রতিটি ভাষাকেই তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও স্বাধীন সত্তা নিয়ে টিকে থাকার অধিকার দেওয়া। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বাংলা ভাষা যদি একটি রাজ্য থেকে ক্রমে অবলুপ্তির দিকে যায়, আর আমরা কেউ তা আটকাতে না পারি, তাহলে ভাষা দিবসে এত অনুষ্ঠান করেই বা কী লাভ! একটা সময় যে কারণে বাংলাদেশ ও আসামের বাঙালিরা আন্দোলন করে প্রাণ দিয়েছিল ভাষার জন্য, আবেগে রক্ত ঝরিয়েছিল; সেই বাংলা ভাষাকে গ্রাস করে নিচ্ছে হিন্দি ভাষার সাম্রাজ্যবাদ। আজ ঝাড়খণ্ডে, কাল তা পশ্চিমবঙ্গে যে হবে না- সেটিই বা কে জানে? আমরা কি সেই বিপৎসংকেত আজও দেখতে পাচ্ছি না? বাংলা ভাষার এই বিপদের দিনে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। না হলে বাংলা লুপ্ত একটি ভাষাতে পরিণত হবে আগামী দিনে।
বাংলা ভাষার জন্য যেখানে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র তৈরি হলো, একটি জাতির পরিচয় তৈরি হলো এবং সারাবিশ্ব পেল 'মাতৃভাষা দিবস'; সেই ভাষাই আজ সংকটজনক অবস্থায়- ভাবলেই কেমন শিউরে উঠতে হয়।
বেবী সাউ: কবি ও প্রাবন্ধিক; ভারতের রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক
মন্তব্য করুন