একটা শহরকে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত করা বা ঝুঁকি কমিয়ে আনার জন্য যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলোর দায় থাকে। তেমনি নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে। এভাবে যৌথ উদ্যোগেই শহরকে নিরাপদ করা যায়। যে ঘটনাগুলো ঘটছে, বিদ্যুৎ-গ্যাস থেকেই ঘটছে। এই সার্ভিসগুলোতে মানসম্মত উপকরণ ব্যবহার করা, সময় সময় নিয়মিত তদারকি করা প্রয়োজন। ভবনের ব্যবহারকারীরা জানেন, তাঁর ভবনের কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে। তাঁরা যদি সজাগ না থাকেন, তাহলে ছোট ছোট সমস্যা হতে হতে একসময় সেটা অনেক বড় সমস্যায় পরিণত হয়। তখনই বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

যারা শহরের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত, যেমন– রাজউক, সিটি করপোরেশন, তিতাস বা বিদ্যুৎ বিভাগ; এই সেবা প্রতিষ্ঠান যে সার্ভিসগুলো দেয়, সেটার তদারকি তাদেরই করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস দুর্যোগকালে কাজ করে। প্রতিটি সংস্থার নিজস্ব দায়দায়িত্ব আছে। 

নিমতলী-চুড়িহাট্টার মতো ঘটনাগুলোর পর অনেক হৈচৈ হয়, তখন টকশো হয়, লেখালেখি হয়। কিছুদিন পর সেই ক্রেজটা কমে যায়; ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। কিন্তু একটা শহরকে ঝুঁকিমুক্ত বা শহরের ঝুঁকি কমাতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগোতে হয়। চুড়িহাট্টার পর যেসব সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন হয়নি। এ ক্ষেত্রে সুশাসনের অনেক ঘাটতি রয়েছে।

আরেকটি হলো বিল্ডিং কোড ও নিয়মকানুন মানানো। মানুষ এগুলো মানতে চায় না। কিন্তু মানাতে হবে। অনেকেই রাজউকের কাছ থেকে প্ল্যান একরকমভাবে নেয়। পরবর্তী সময়ে ব্যবহারের ধরন পরিবর্তন করে ফেলে। তদারকিও দুর্বল থাকে। সিদ্দিকবাজারে গ্যাস-স্যুয়ারেজের লাইন দিনের পর দিন মনিটরিংয়ের বাইরে থেকেছে। আবার ভবনটি যেভাবে অনুমোদন নিল, সেভাবে কাজ করে কিনা। বিল্ডিং পরিদর্শক যাঁরা আছেন, তাঁদের দায়িত্ব নিয়মিত ভবনগুলো পরিদর্শন করা। একটি ভবন ব্যবহার করার শুরুতেই ছাড়পত্র নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু কেউ ছাড়পত্র সার্টিফিকেট নেয় না। সবকিছু মিলে শহরটাকে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছি।

আমাদের বিল্ডিংয়ের ডিজাইনের দিক থেকে একটা সমস্যা দেখি। এ দেশে প্রচুর আলো-বাতাস আছে। এই প্রাকৃতিক পরিবেশকে আমরা নষ্ট করে দিয়ে এসিনির্ভর কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে ভবন বানাচ্ছি। তখন জানালা-দরজাকে বন্ধ করে ফেলতে হয়। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বাইরের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ভবনের হয়তো কোনো একটি স্থানে ক্রমান্বয়ে গ্যাস জমতে থাকে, যেটা স্যায়েন্স ল্যাব এলাকার শিরিন ম্যানসনে হয়েছে। এখানেও একই রকম ঘটনা ঘটছে মনে হয়। বিল্ডিং ডিজাইনের ক্ষেত্রে কেন প্রাকৃতিক পরিবেশকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি না– এটা ভাবা প্রয়োজন।

ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ রয়েছে। যাঁরাই ভবন তৈরি করবেন, তাঁদের এ দুইটা আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই এটা কার্যকর করতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, একটা দুর্ঘটনার কিছুদিন পর জনজীবন আগের মতোই চলতে থাকে। এ জন্য সমস্ত শহরকে ছোট ছোট ব্লকে ভাগ করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রতিটি ভবন আলাদা করে দেখা দরকার কী কী দুর্বলতা আছে। দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে ঝুঁকিটাকে হ্রাস করার জন্য কী কী পরিবর্তন করা যায়, সেটার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি বলছি না, সমস্ত ভবন ভেঙে ফেলতে হবে। সারা শহরকে একসঙ্গে করলে কোনোটাই কাজে আসবে না। ব্লকে ভাগ করে প্রতিটি ভবন পরিদর্শন করে সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। রাজউক বিল্ডিংয়ের নকশার ব্যত্যয় দেখবে। বিদ্যুৎ তাদের অংশ দেখবে। তিতাস তাদের গ্যাসের অংশ দেখবে। এভাবে যেসব সংস্থার যে কাজ আছে, তারা সেই কাজটি করবে। এ ক্ষেত্রে তাদের যদি জনবলের অভাব থাকে, তারা প্রয়োজনে বাইরে থেকে জনবল হায়ার করতে পারে।

লেখক: নগর পরিকল্পনাবিদ এবং অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়