মা-বাবার জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করছিল স্কুলপড়ুয়া দুই ভাইবোন নাইম ও মায়মুনা। তাদের মা-বাবা মার্কেটে গিয়েছিলেন বেসিনের জন্য আয়না কিনতে। যাওয়ার আগে বলেছিলেন, জলদি ফিরবেন। তবে দীর্ঘ সময়েও তাঁদের ফেরার নামগন্ধ নেই। ফোন করেও কোনো সাড়া মিলছিল না। পরে আত্মীয়দের মাধ্যমে দুই শিশু জানতে পারে, দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন তাঁরা। চিকিৎসা নিয়ে দ্রুতই ফিরবেন। অবশেষে একসময় তাঁরা বাড়িতে ফিরেছেন, তবে লাশ হয়ে।

শিশু দুটির বাবা মমিনুল ইসলাম (৩৮) ছিলেন ব্যবসায়ী। আর তাদের মা নদী ইসলাম (৩৬) গৃহিণী। মঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান এলাকার সিদ্দিকবাজারে ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে তাঁরা প্রাণ হারান। স্বজনরা বলছেন, ‘আয়নায় মানুষের ছবি (প্রতিবিম্ব) দেখা যায়। সেই আয়না কিনতে গিয়ে ওরা নিজেরাই ছবি হয়ে গেল।’

পুরান ঢাকার ইসলামবাগের ছাতা মসজিদ গলিতে নিজেদের পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলায় থাকতেন এই দম্পতি। গতকাল বুধবার সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকে কাতর হয়ে আছেন স্বজনরা। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া মায়মুনা (১৪) ও মাদ্রাসাছাত্র নাইম (১৩)।

নিহত মমিনুলের মামা রফিকুল ইসলাম সমকালকে জানান, নিউমার্কেটে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবসা আছে তাঁর ভাগ্নের। মাঝেমধ্যেই তিনি তাবলিগে যেতেন। সর্বশেষ তিন দিনের তাবলিগ শেষে মঙ্গলবার বাড়িতে ফেরেন। এর পরপরই তিনি স্ত্রীকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বের হন। তখন স্ত্রী তাঁকে বলেছেন, আয়না পরে কিনলেও চলবে। তবে মমিনুল সে কথা শোনেননি। মার্কেটে যাওয়ার আগে মমিনুল বলেছিলেন, তাঁর বড্ড ঘুম পেয়েছে। আয়না কিনে বাড়িতে এসে ঘুমাবেন। কিন্তু কে জানত, ঘুমাতে যাওয়ার আগেই চিরঘুমে যেতে হবে তাঁকে!

রফিকুল বলেন, ‘দুর্ঘটনার খবর শুনে আমি ছুটে যাই ঘটনাস্থলে; পরে যাই হাসপাতালে। প্রথমে আশা করেছিলাম, হয়তো আহত হয়েছে, কিন্তু বেঁচে আছে। পরে দেখি, দু’জনই ঘটনাস্থলে মারা গেছে। কিছুটা দূরে মোটরসাইকেল রেখে ভবনটির সামনে পৌঁছেছিল দু’জন। তাঁরা রাস্তায় থাকতেই বিস্ফোরণ ঘটে। আহারে, একটা সংসার এভাবে শেষ হয়ে গেল!’

তিনি জানান, দুই নাতি-নাতনি তাঁকে বারবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছিল, ‘নানাভাই, আব্বু-আম্মুর কী হয়েছে? বাড়িতে আসছে না কেন?’ তিনি মিথ্যা করে বলেছেন, একটু আহত হয়েছে, এখনই ফিরবে। পরে গভীর রাতে যখন দু’জনের লাশ বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সত্যিটা জানতে পারে দুই শিশু। এর পর থেকে তাদের কান্না থামছেই না।

গতকাল সকালে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে এই দম্পতিকে দাফন করা হয়েছে।

‘আব্বায় এখন কী নিয়া বাঁচব?’: ‘ভাই, তুই কেন গেলি আইজকা কেনাকাটা করতে? না গেলে তো এমন হইত না রে। ওরে, আব্বায় এখন কী নিয়া বাঁচব?’ মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এভাবে আহাজারি করছিলেন নিহত ব্যবসায়ী মনসুর হোসেনের (৪০) বড় ভাই কাওসার হোসেন। একই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তাঁর খালাতো ভাই শিক্ষার্থী আল আমিন (২৩)। 

কাওসার জানান, মনসুর গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া-১ মার্কেটে মশারির ব্যবসা করতেন। তাঁর দোকানের নাম ‘হাবিব বেডিং’। মঙ্গলবার বিকেলে দুই ভাই স্যানিটারি সামগ্রী কিনতে যান। তাঁরা রাস্তায় থাকতেই বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই তাঁদের মৃত্যু হয়।

কথা বলতে বলতেই তাঁর মোবাইল ফোনে কল আসে। পাশে বসে থাকা তাঁর বোন কল রিসিভ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মনসুর আর নাই গো, আলামিনও নাই। সব শ্যাষ হইয়া গেছেগা। কিচ্ছু নাই।’

স্বজনরা জানান, বিস্ফোরণের সময় পাশের ভবনের কাচ ও স্টিলের কাঠামো এসে পড়ে দুই ভাইয়ের ওপর। পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শেখদী এলাকায় থাকতেন মনসুর। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে। ঢাকায় তাঁর বাসায় এসেছিলেন আল আমিন।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সমকালের মিটফোর্ড প্রতিবেদক মোক্তার হোসেন।]