রাজধানীর অতিঝুঁকিপূর্ণ ৪২টি ভবন এক সপ্তাহের মধ্যে খালি করতে গতকাল রোববার ভবন মালিক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ভবন মালিকদের নিজ উদ্যোগে ভেঙে ফেলতে সময় দেওয়া হয়েছে দুই মাস। অন্যথায় রাজউক অপসারণ করে মালিক পক্ষের কাছ থেকে খরচ আদায় করবে।

গত শনিবার নগর উন্নয়ন কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঝুঁকির তালিকায় থাকা আরও ১৮৭টি ভবন মালিককে স্থাপনায় রেট্রোফিটিং করতে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তবে সহসাই এসব অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙা পড়ছে না। ভবন মালিক কর্তৃপক্ষের দাবি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কয়েক মাস আগে করা জরিপে তাদের রাখা হয়নি। অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর অধিকাংশই সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভাঙার আগে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বর্তমান কার্যক্রম স্থানান্তর করতে বিকল্প জায়গা আর ভাঙতে অর্থ লাগবে। তাই হুট করেই ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে না।

অতিঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) তিনটি ভবন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) চারটি ভবন আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) তিনটি ভবন রয়েছে। এ ছাড়া জাবির ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রেট্রোফিটিং করে ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। রাজউক থেকে এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেওয়া হলেও কোন ভবন ভাঙতে হবে, আর কোনটি রেট্রোফিটিং করতে হবে– সেটিই নির্দিষ্ট করা হয়নি।

বিএসএমএমইউর প্রকৌশল দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ব্লক আর ‘বি’ ব্লকের ভবন দুটি এই তালিকায় থাকতে পারে। পাকিস্তান আমলে নির্মিত ‘এ’ ব্লকের ভবনটির নিচতলা আর দ্বিতীয় তলায় মিলনায়তন, তৃতীয় তলায় ট্রান্সফিউ মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ডেন্টাল অনুষদ, চতুর্থ তলা থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ‘বি’ ব্লক নামে পাঁচতলা ভবনটি বর্তমানে প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিচতলায় হলরুম. দ্বিতীয় তলায় ভিসি ও প্রো-ভিসির রুম, তৃতীয় তলায় রেজিস্ট্রার, প্রকৌশল দপ্তর, অর্থ ও হিসাব দপ্তর, চারতলায় প্রক্টর দপ্তর ও ছাত্রাবাস, পঞ্চম তলায় মানবসম্পদ দপ্তর আর ছাত্রাবাস রয়েছে।

বিএসএমএমইউর প্রধান প্রকৌশলী জাফর ইকবাল সমকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা কোনো চিঠি পাননি। কয়েক মাস আগে রাজউকের একটি দল এসে জরিপ চালালেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ভবন ভেঙে ফেলতে হবে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি। পাকিস্তান আমলের ভবন থাকলেও আমার মনে হয় না, ভেঙে ফেলার মতো কোনো ভবন আছে। চিঠি দিয়ে নির্দিষ্ট ভবন উল্লেখ করলে কর্তৃপক্ষ আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবে। তবে সব ভবনেই হাসপাতালের কার্যক্রম চলমান। চাইলেই ভাঙা সম্ভব নয়।

রাজউকের অতিঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি পাঁচতলা আর দুটি চারতলা ভবন উল্লেখ করলেও কোন কোন ভবন তা নির্দিষ্ট করা হয়নি চিঠিতে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ভবন এবং কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের চারটি ভবন অতিঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে। তবে এ চার ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকের বেশি বিভাগের একাডেমিক কার্যক্রম চলমান। দুই মাসের মধ্যে ভেঙে ফেললে একাডেমিক কার্যক্রম চালানোর বিকল্প কোনো জায়গা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবন ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ সবক’টিই পুরোনো ভবন। তবে রাজউকের মান অনুযায়ী, ভেঙে ফেলার মতো পরিস্থিতি কোনোটিতেই নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ইমদাদুল হক বলেন, রাজউক অতিঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ভবন নির্দিষ্ট না করলেও এখন কোনো ভবন ভাঙা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানের বিকল্প জায়গা নেই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে রেট্রোফিটিং করে ব্যবহার উপযোগী করতে নোটিশ দিয়েছে রাজউক। আর তিনটি ভবন ভেঙে ফেলতে বলা হয়েছে। রাজউক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি গেলেও সেখানে এসব ভবন নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের আ ফ ম কামালউদ্দিন হল ও শহীদ সালাম বরকত হলের হাউস টিউটরদের ‘ডি’ টাইপের একটি ভবন, বিশমাইল এলাকার একটি ‘ই’ টাইপ ভবন, জিমনেশিয়াম ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নির্মিত আল বেরুনী হল, ব্যাচেলর কোয়ার্টার, ফজিলাতুন নেছা হলসহ বিশমাইল এলাকার বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী কোয়ার্টার ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ বলেন, তিন দিন আগে আমাদের কাছে একটি চিঠি এসেছে। কিন্তু সেখানে কোন কোন ভবন ভাঙতে হবে, তা উল্লেখ নেই। আমি তা জানার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলীকে বলেছি, যেন তিনি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

নগর উন্নয়ন কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তালিকায় সবচেয়ে বেশি আছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ভবন। অধিদপ্তরের ১৫৪টি ভবন রেট্রোফিটিং আর ৩০টি ভবন ভেঙে ফেলতে বলা হয়েছে। তবে এ-সংক্রান্ত কোনো চিঠি রোববার পর্যন্ত অধিদপ্তর পায়নি। পেলেও তাঁরা এসব ভবন ভেঙে ফেলার কেউ নন বলে জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন তৈরি করে দেওয়া। নির্মিত ভবন হস্তান্তরের পর সেটি ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর মাউশির সম্পত্তি। এসব ভবন চাইলেই আমরা ভাঙতে পারি না। মাউশিই সিদ্ধান্ত নেবে কোন ভবন ভাঙা হবে। তবে এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিকল্প জায়গা আর অর্থায়নের বিষয় আছে।

ঝুঁকিপূর্ণের তালিকার ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির তিনটি, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চারটি, মাদ্রাসা বোর্ডের ছয়টি, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ১০টি ভবন রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে ইউআরপি। এ ছাড়া মাদ্রাসা বোর্ডের একটি ভবন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি ভবন ভাঙার কথা বলা হয়েছে। তবে এসব ভবনের মালিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিকল্প জায়গা আর অর্থায়নের বিষয়টি ঠিক হলেই শুধু ভবন ভাঙা আর সংস্কার শুরু করা যাবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ দেলোয়ার হায়াত বলেন, রাজউক থেকে এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি পাননি। রাজধানীর ৩৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। নিজেদের জরিপ থেকে স্কুলের ভবন সংস্কারও চলছে। এর মধ্যে রাজউকের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা আর আমাদের তালিকা মিলে যেতে পারে। ব্যতিক্রম হলে সেগুলোও আমলে নেব। তবে তালিকায় না মিললে ভেঙে ফেলতে হয়তো কিছু সময় আরও লাগবে।

এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সমকালের জবি ও জাবি প্রতিবেদক]