চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রী হলও হাঁটছে ছাত্র হলের পথে। চবি ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে অনুসরণ করে ছাত্রী হলে রামরাজত্ব চালাচ্ছেন ১০ নেত্রী। দাপট ও ক্ষমতায় পিছিয়ে নেই তাঁরাও। ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে যেতে সাধারণ ছাত্রীদের বাধ্য করেন। এমনকি হলে আসন পেতে তাদের কাছ থেকে নিতে হয় ছাড়পত্রও। কেউ কেউ টাকা নিয়ে আসন বিক্রিও করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁদেরই একজন সীমা আরা শিমু।

খালেদা জিয়া হলে টাকার বিনিময়ে আসন দেওয়ার লিখিত অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। একই রকম লিখিত অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের উপ-স্কুল ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক সাজমুন্নাহার ইষ্টির ব্যাপারে। তিনিও টাকার বিনিময়ে হলে আসন বিক্রি করছেন। খালেদা জিয়া হলের ৩২৫ নম্বর কক্ষে থাকা চবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীমা সীমার বিরুদ্ধে আছে অন্য রকম অভিযোগ।

চারজনের কক্ষের নিয়ম ভেঙে তিনি থাকছেন শুধু তাঁর এক অনুসারীকে নিয়ে। সীমার চেয়ে আরেক কাঠি ওপরে যেন শিমু। তিনি চবি ছাত্রলীগের উপ-স্কুলবিষয়ক সম্পাদক। তাঁর কক্ষে অনুসারীরা ছাড়া আর কেউই থাকতে পারেন না । চবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি ফাল্গুনী দাশ, উপ-ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক তাহরিমা আক্তার মিলকি ও উপ-কর্মসংস্থানবিষয়ক সম্পাদক কানিজ ফাতেমা কেয়া ছড়ি ঘোরান প্রীতিলতা হলে। এদের মধ্যে ফাল্গুনী সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুর অনুসারী। তাহরিমা আক্তার মিলকি সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের গ্রুপ সিএফসির অনুসারী। একইভাবে শামসুন নাহার হলে মাবিয়া পারভিন, খালেদা জিয়া হলে শফি লতা এবং জননেত্রী শেখ হাসিনা হলে আফরিন লিমু ও নুসরাত জাহানের দাপটে অতিষ্ঠ সাধারণ ছাত্রীরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নারীদের গ্রুপ আছে দুইটি। একটি হলো স্বাধীনতা, অন্যটি সংগ্রাম। সংগ্রামের নেতৃত্বে আছেন শামীমা সীমা; স্বাধীনতা গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন রুম্পা সরকার। তবে ছাত্রী হলের নেতৃত্বে এ দুই গ্রুপ ছাড়াও বগিভত্তিক উপদল সিক্সটি নাইন ও সিএফসি গ্রুপের অনুসারীরাই থাকেন বেশি।

যত অভিযোগ: চবির চারটি ছাত্রী হলে মোট আসন রয়েছে ২ হাজার ২৭০টি। চার ছাত্রী হলে অবস্থান করা ১৫ জন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, ছাত্রী হলে আগে রাজনীতির প্রভাব কম থাকলেও এখন সেটির মাত্রা ব্যাপক। কিছু নেত্রী ছাত্রীদের সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেন। ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ না নিলে হল থেকে বের করে দেওয়ারও হুমকি দেন। ছাত্রী হলে এখন র‍্যাগিংয়ের মতো ঘটনাও ঘটছে। চবি ছাত্রী হলের কোনোটি চারজনের, কোনোটি দু’জনের আসনবিশিষ্ট। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এসব কক্ষে তিন থেকে পাঁচজনও থাকেন। কিন্তু ছাত্রী হলের নেত্রী যাঁরা, তাঁদের জন্য নিয়ম ভিন্ন। চারজনের কক্ষেও তাঁরা থাকেন দুইজনে। আবার দুইজনের কক্ষে থাকেন একজন। প্রভোস্ট কিংবা হাউস টিউটরের অনুমতি নেওয়াকেও এখন আর পাত্তা দেন না এসব নেত্রী। এটি নিয়ে শিক্ষকরা কোনো ব্যবস্থা নিলে তাঁকে পদত্যাগের জন্য চাপও তৈরি করেন তাঁরা। বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগের নেত্রীদের প্রশ্রয় দেন অনেক হল প্রভোস্ট ও হাউস টিউটর।

ছাত্র হলের পথেই হাঁটছে ছাত্রী হল: সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেউ এসব নারী নেত্রীর ভয়ে মুখ খুলছেন না। অনেক কথা তাঁরা বললেও নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না গণমাধ্যমের কাছে। একটি কক্ষের বাইরে বড় করে লেখা দেখা গেছে সীমা আরা শিমুর নাম। সরেজমিন দেখা যায়, তাঁর এ কক্ষটিতে আড্ডা দিচ্ছেন শিমুর অনুসারীরা। এদের কারও আসন বরাদ্দ না থাকলেও এ কক্ষেই আছে তাঁদের অবাধ বিচরণ। ছাত্রলীগ নেত্রী শিমু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় গ্রুপের নেত্রী। শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক এ গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন চবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াছ। তাই এ হলে অবাধ বিচরণ শিমু ও তাঁর অনুসারীদের। একই চিত্র অন্যান্য হলে।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী শাহনাজ মুন্নি বলেন, আমি চতুর্থ বর্ষে পড়ি। হল প্রভোস্টদের কাছে আমরা যখন আসনের জন্য আবেদন করি, তাঁরা ব্যবস্থা করতে পারেন না। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীরা প্রভাব খাটিয়ে সিট দখলে নেন। এখানে প্রশাসনকেও কঠোর হতে হবে।

টাকা নিয়ে আসন বরাদ্দ: খালেদা জিয়া হলে টাকা নিয়ে কক্ষে ওঠানোর লিখিত অভিযোগ পেয়েছে প্রশাসন। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি এ হলের ছাত্রলীগের উপ-স্কুল ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী সীমা আরা শিমু এবং উপ-ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী সাজামুন্নাহার ইষ্টির বিরুদ্ধে উঠেছে এমন অভিযোগ। লিখিত অভিযোগ করেন ইতিহাস বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী সালেহা খাতুন ও বাংলা বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী শম্পা রানী।

অভিযোগে তাঁরা উল্লেখ করেন, রিমা নামে এক জুনিয়র কর্মীর মাধ্যমে ওই দুই নেত্রী তাঁদের কাছ থেকে বিকাশে ৫০০ করে টাকা নিয়েছেন। টাকা না দিলে তাঁদের হলে উঠতে দেবেন না নেত্রীরা। এ বিষয়ে খালেদা জিয়া হলের হাউস টিউটর ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শারমিলা কবির সীমা বলেন, টাকা দিয়ে সিট দেওয়ার অভিযোগ আমি শুনিনি। অন্যান্য অভিযোগ নিয়ে নতুন প্রভোস্ট নিয়োগের পর কাজ করবেন বলে জানান তিনি।

শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. একেএম রেজাউর রহমান বলেন, হলের আসন বরাদ্দের কাজ আমরা রোজার সময় এগিয়ে নেব। তবে রাজনৈতিক নেত্রীদের আধিপত্য শেখ হাসিনা হলে আমি তেমন দেখিনি। শামসুন নাহার হলের প্রভোস্ট ড. নাজন রকিবা নবী বলেন, প্রশাসনিক কিছুটা সমস্যা চলছে। এ কারণেই কাজগুলো কিছুটা বন্ধ আছে। খুব শিগগিরই এগিয়ে যাবে।

অভিযুক্ত নেত্রীদের বক্তব্য: ছাত্রীদের নানা অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে চবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীমা সীমা বলেন, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমরা হলের উন্নয়নে কাজ করি। ছেলেদের হলে যে রকম গ্রুপিং করে, তার ছিটেফোঁটাও মেয়েদের হলে নেই।

খালেদা জিয়া হলের মতো র‍্যাগিং ও সিট দখলের অভিযোগ আছে প্রীতিলতা হলেও। এই হলের নেত্রী ও চবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি ফাল্গুনী দাশ বলেন, র‍্যাগিং কিংবা হলের সিট দখলের এসব অভিযোগ সঠিক নয়। সমস্যায় আছে এমন মেয়েদের হলে তোলার ব্যাপারে আমরা সুপারিশ করি। খালেদা জিয়া হলের ছাত্রলীগ কর্মী শফি লতার বিরুদ্ধে অন্যের রুম জোর করে দখল করার অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এটি সত্য নয়। আমি কাউকে হুমকি দিইনি।