- রাজধানী
- আছে হাতা গুটিয়ে রাখা শার্ট-চেয়ার-টেবিল, নেই শুধু ঢাবির নুর নবী
সায়েন্সল্যাব এলাকায় বিস্ফোরণ
আছে হাতা গুটিয়ে রাখা শার্ট-চেয়ার-টেবিল, নেই শুধু ঢাবির নুর নবী

নুর নবী।
টেবিলে রাখা বইয়ের ভেতর এখনো কলম দিয়ে রাখা। পাশে বন্ধ টেবিল ল্যাম্প। আর পুরো টেবিল জুড়ে বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির বই। বইগুলোতে মোটা কলমে ইংরেজিতে লেখা ‘নুর নবী’। ভালোভাবে খেয়াল করলে বুঝা যায়, নিয়মিতই সেগুলো পড়া হয়। এক পাশে দৈনিক পত্রিকা রাখা। পাশে দেয়ালে ঝুলে আছে হাতা গুটিয়ে রাখা শার্ট, প্যান্ট ও অন্যান্য পোশাক। আছে বিছানা, চেয়ার আর টেবিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ‘এক্সটেনশন’ ভবনের ২০১০ নম্বর কক্ষ। এখানে থাকতেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. নুর নবী। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার একটি ভবনে বিস্ফোরণে গুরুতর জখম হয়ে গতকাল মঙ্গলবার মারা গেছেন তিনি।
স্বপ্ন ছিল বিসিএস ফরেন ক্যাডার, অ্যাডমিন ক্যাডার অথবা পুলিশ ক্যাডার। ভালো পড়াশোনা করতেন, বিভাগেও ছিলেন পরিচিতমুখ। পরীক্ষার আগে নোট সংগ্রহ করে সবাইকে দিতেন। কেউ তার কাছে পড়াশোনার বিষয়ে সাহায্য চেয়ে ফিরতে হয়নি। কাছের বন্ধুদের বলতেন, ‘বিসিএস প্রিলিমিনারিতে তার সমস্যা নেই, লিখিত অংশ নিয়ে একটু সমস্যা।’ বড় ভাই আলী হোসেন নুর সজল ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) এসআই। প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভাইয়ের সঙ্গে সংসারের হাল ধরবেন।
গত ৫ মার্চ ‘৪০৬ : স্টাডি অব রিলিজিয়ন’ কোর্সে কিছুক্ষণ ক্লাস নিয়ে ছুটি দিয়ে দেন শিক্ষক শেখ ইউসুফ। এরপর বঙ্গবন্ধু হলের গেট দিয়ে বের হয়ে সায়েন্সল্যাবে দিকে রওনা হন নুর নবী। উদ্দেশ্য একটি কোচিং সেন্টারে বিসিএস লিখিত নিয়ে ক্লাসে অংশ নেবেন। তবে স্বপ্ন পূরণে আর এগিয়ে যেতে পারেননি। তার আগেই সাঙ্গ হলো জীবন। সায়েন্সল্যাবের বিস্ফোরণে ভারী জিনিসপত্র গায়ে পড়ে পা ভেঙে যায় আর মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আনা হয়। ১৬ দিন পর পরপারে পাড়ি জমালেন নুর নবী।
নুর নবীর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার দড়িগাঁও গ্রামে। পরিবারে বাবা মা আর তিন ভাই। ছোট ভাই মো. রোহান ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। গতকাল ঢামেকের বারান্দায় হাউমাউ করে কাঁদছিলেন বাবা স্ট্রোকের রোগী জসিম উদ্দীন। বিলাপ করে বলছিলেন, ‘বড় কষ্ট করে ছেলেদের মানুষ করেছি আমি। আমার কিছুই ছিল না। বড় ছেলের চাকরির পর কিছুটা স্বচ্ছলতা আসে। ছেলে আমার পড়াশোনার সঙ্গে থাকত। কয়েকদিন পর হয়ত ছেলে চাকরির সুসংবাদ দিত, সেখানে ছেলে আমার দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে।’
ঢামেকের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোজাফফর হোসেন বলেন, নুর নবীর মাথার ১৫ শতাংশের সাত ভাগই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এক পা ভেঙে গিয়েছে পুরোই। প্রথম দিন থেকে আইসিইউতে ছিল। অবস্থা এমন শঙ্কায় ছিল যে, আইসিইউ থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নেওয়ার অবস্থায় ছিল না।
নুর নবীর কাছের বন্ধু ছিলেন একই বিভাগের ইমরান মাহমুদ। থাকতেন একই হলে। ইমরান সমকালকে জানালেন, ‘একসঙ্গে ছিল আমাদের চলাফেরা। আঘাত পাওয়ার আগেরদিন রাতে আমার রুমে আসে। যেদিন জখম হয়, সেদিন ক্লাসেও কথা হয়। এ কয়েকদিন আমরা তার কাছেই ছিলাম। বন্ধু নেই এটা আমার এখনো বিশ্বাস হয় না।’
বড় ভাই আলী হোসেন বলছিলেন, ‘আমার ভাই প্যারালাইজড হোক, শারীরিক যেই অবস্থা থাকুক, সে বেঁচে থাকুক। আমি তার দেহটা জীবিত থাকুক এটাই চাই। আমি জীবনভর ভাইকে দেখে রাখতাম। কিন্তু ভাই আমার থাকল না।’
তার রুমমেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন বলেন, এত অমায়িক ছিল নুর নবী, কারো সঙ্গে কোনো মনোমালিন্য ছিল না তার। আমরা এত চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারিনি। তার সকল জিনিসপত্র যেভাবে রাখছিল, সেভাবেই রাখা আছে। আমরা তার পরিবারকে সবকিছু বুঝিয়ে দেব।
গত ৫ মার্চ সায়েন্সল্যাবে এক ভবনের তিনতলায় ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের অফিসে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এমন ছিল যে, পাশের একটি ১৪ তলা আবাসিক ভবন কেঁপে ওঠে। এ ঘটনায় নুর নবীসহ ছয়জনের প্রাণহানি ঘটে।
মন্তব্য করুন