স্থপতি ইমতিয়াজ মোহাম্মদ ভূঁইয়ার (৪৭) বিবাহবার্ষিকী ছিল ৭ মার্চ। ওই দিন সন্ধ্যার পর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। নকশা প্রিন্ট করানোর কথা বলে দুপুর সোয়া ১টার দিকে তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে বের হন। এর পর আর ফিরে আসেননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে পরদিন কলাবাগান থানায় জিডি করে তাঁর পরিবার। ১৮ মার্চ স্বজনরা নিশ্চিত হন, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের মরিচা সেতুর কাছে পাওয়া অজ্ঞাত লাশটি ইমতিয়াজের। যদিও ৮ মার্চ লাশটি পাওয়ার পর অজ্ঞাত হিসেবে পরদিন আঞ্জুমান মুফিদুলের মাধ্যমে দাফন করা হয়। কারা, কেন ইমতিয়াজকে হত্যা করল– এ নিয়ে তদন্ত শুরু করে একাধিক সংস্থা। জিডির পর থেকেই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ছায়া তদন্ত শুরু করে। তদন্তের এক পর্যায়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য সামনে আসে।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ডিবির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে জানান, ঘটনার দিন ১টা ১০ মিনিটের দিকে তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে বের হয়ে কলাবাগান এলাকায় যান ইমতিয়াজ। রাত ৮টা পর্যন্ত তাঁর মোবাইল ফোন সচল ছিল। কলাবাগানের ক্রিসেন্ট রোডের একটি বাসায় তাঁর অবস্থান ছিল বলে প্রযুক্তির সহযোগিতায় জানা যায়। সন্দেহভাজন এক নারীসহ চার থেকে পাঁচজন একই বাসায় অবস্থান করছিলেন। যে সময় ইমতিয়াজের মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়, ঠিক একই সময় অন্যদেরও মোবাইল ফোন বন্ধ হয়। সিসিটিভির ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, ওই এলাকার একটি বাসা থেকে সন্দেহভাজন একটি প্রাইভেটকার ওই রাতে বের হয়ে মুন্সীগঞ্জের মরিচা সেতুর কাছে যায়। সেখানে লাশ ফেলে আবার গাড়িটি ফেরত আসে।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে জানায়, হত্যা চক্রে যাঁরা রয়েছে, তাদের সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে পুলিশ। এই চক্রে একজন নারী রয়েছে। স্থপতি ইমতিয়াজ প্রতারণার ফাঁদে পড়েছিলেন। এই চক্রটি এক ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে অনেককেই প্রতারণার মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে। সেখানে গ্রুপভিত্তিক নানা ধরনের প্রতারণার কাজ চলত। কলাবাগানের ওই ফ্ল্যাটটি কাজেই ব্যবহার করা হচ্ছিল।

গোয়েন্দা পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, চক্রের সদস্যরা কলাবাগানের ওই বাসায় ইমতিয়াজকে জিম্মি করেছিল। এর পর তাঁর কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ওই অর্থ দিতে রাজি না হওয়ায় ইমতিয়াজকে মারধর করে হত্যা করা হয়। কয়েকজন মিলে তাঁকে মারধর করেছে। হত্যার পরপরই ওই রাতে তাঁর লাশ গুম করতে মুন্সীগঞ্জ নেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি গোলাম সবুর সমকালকে বলেন, জিডির পর থেকেই এই ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করেন তাঁরা। ডিবি জানায়, দুই থেকে তিনটি কারণ সামনে নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। ডেকে নিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে– এটা মোটামুটি নিশ্চিত। চক্রের সবাইকে গ্রেপ্তার করা গেলে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে। দু-এক দিনের মধ্যে বিস্তারিত বলা যাবে।

ইমতিয়াজ ঢাকার তেজগাঁও এলাকার মোহাম্মদ হোসেন ভূঁইয়ার ছেলে। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির নকশার কাজ করতেন। তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। স্ত্রী ফাহামিদা আক্তার কলাবাগান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

ইমতিয়াজের ছেলে তিহাহ সমকালকে বলেন, সিরাজদীখানে উদ্ধার হওয়া লাশটি আমার বাবার। আমার বাবা অত্যন্ত সহজসরল ছিলেন। কারও সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে শত্রুতা ছিল না। ৭ মার্চ নিখোঁজের পর আমরা আত্মীয়স্বজনসহ সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করি। ১০ মার্চ একটি টেলিভিশনে নিখোঁজের সংবাদ প্রচার করা হয়। সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্নভাবে শেয়ার করা হয়। সেখানেই এক ব্যক্তি কমেন্ট করে জানান, এই চেহারার একটি লাশ সিরাজদীখানে পাওয়া গেছে। আমরা বিষয়টি থানায় জানাই।’

মুন্সীগঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ৮ মার্চ সন্ধ্যায় সিরাজদীখানের মরিচা সেতু এলাকা থেকে লাশটি অজ্ঞাতপরিচয়ে উদ্ধার করা হয়। লাশের পরিচয় না পাওয়ায় ৯ মার্চ আইনি প্রক্রিয়া শেষে বেওয়ারিশ হিসেবে ঢাকার আঞ্জুমান মুফিদুলে হস্তান্তর করা হয়। তারা পরদিন লাশের দাফন করে। তবে আমরা লাশের ডিএনএ রেখে দিয়েছিলাম। তেজগাঁও থানা পুলিশ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরে ২১ মার্চ আমরা পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করি।

মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুর রহমান আল মামুন সমকালকে বলেন, অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে লাশটি পাওয়ার পর যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুরু সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। মুখজুড়ে আঘাতের চিহ্ন দেখে নিয়মিত মামলা রুজু করা হয়।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, সন্দেহভাজন যে চক্রটি ইমতিয়াজকে হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন ইমতিয়াজের পূর্বপরিচিত। দু-তিনজনের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। পাঁচজনকে শনাক্ত করা গেছে। তাদের যে কোনো সময় গ্রেপ্তার করা হবে।

শুরুতে কেন ইমতিয়াজের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি– এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জের এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ৮ মার্চ লাশ উদ্ধারের দিনে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইর সদস্যরা ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে লাশের পরিচয় জানার চেষ্টা করেন। তবে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য মিল ছিল না। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় ডিএনএ আলামত রাখা হয়।