ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

বন্দি বাকস্বাধীনতা ও ব্যর্থ গণতন্ত্রের ভারতীয় রূপ

প্রতিবেশী

বন্দি বাকস্বাধীনতা ও ব্যর্থ গণতন্ত্রের ভারতীয় রূপ

অরুন্ধতী রায়

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৩ | ১৮:৫৫

ব্যর্থ গণতন্ত্রের বিষয়ে বলতে গিয়ে আমি প্রধানত ভারতের কথাই বলব। কারণ এটি শুধু বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত নয়, বরং এটি এমন এক দেশ, যাকে আমি ভালোবাসি, যাকে আমি জানি এবং যেখানে আমি বাস করি; যা প্রতিদিন আমার হৃদয় ভেঙে দেয়, আবার মেরামতও করে। দেশটি কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এক সময় অনন্য সম্ভাবনায় পূর্ণ ছিল; যেটি সুখ, পরিপূর্ণতা, সহনশীলতা, বৈচিত্র্য এবং স্থায়িত্ব সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে আমূল ভিন্ন উপলব্ধি দিয়েছিল। তবে এর সবই নিভিয়ে ফেলা হচ্ছে। তাকে আধ্যাত্মিকভাবে স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

শুধু হিন্দু রাষ্ট্র নয়, ঘোরতর পুলিশিও বটে
ভারতের গণতন্ত্রকে পরিকল্পিতভাবে ভেঙেচুরে ফেলা হচ্ছে। থেকে যাচ্ছে শুধু কিছু আচার-অনুষ্ঠান। আসলে মোদি এবং আরএসএস ক্ষমতায় আসার অনেক আগেই এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৫ বছর আগে আমি ‘গণতন্ত্রের ব্যর্থ আলো’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেই সময়ে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস পার্টি। পুরোনো-সামন্তবাদী অভিজাত এবং টেকনোক্র্যাটদের নিয়ে গঠিত দলটি নয়া উৎসাহের সঙ্গে মুক্তবাজারকে বরণ করছিল। সেটা ছিল ২০০৯। এর পাঁচ বছর পর, ২০১৪ সালে মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তবে এই ৯ বছরে ভারত একেবারেই অচেনা রূপ ধারণ করেছে। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে ‘ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’টি প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে পরিচালিত মহান সংগ্রাম এবং দৃঢ়চেতা, দূরদর্শী পরিবেশ আন্দোলনগুলোকে চূর্ণ করা হয়েছে। এখন আমরা খুব কমই মরে যাওয়া নদী, জলের সারণি, অদৃশ্য বন বা হিমবাহ গলার বিষয়ে উদ্বেগ শুনতে পাই। কারণ, সেই উদ্বেগগুলোর জায়গা দখল করেছে আরও তাৎক্ষণিক কিংবা উচ্ছ্বাস; বিষয়টা নির্ভর করে আপনি আদর্শিক লাইনের কোন দিকে আছেন, তার ওপর।

সব দিক থেকেই ভারত কার্যত একটি করপোরেট, ধর্মতান্ত্রিক হিন্দু রাষ্ট্র, উচ্চ পুলিশি রাষ্ট্র এবং একটি ভয়ংকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। পূর্ববর্তী শাসকদের আমলে যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফাঁপা করে দেওয়া হয়েছিল; বিশেষ করে মূলধারার মিডিয়া, সেগুলো এখন হিন্দু আধিপত্যবাদী উন্মাদনায় উদ্বেলিত। একই সঙ্গে মুক্তবাজারও তার কাজ করে চলেছে। অক্সফ্যামের ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুসারে, ভারতের জনসংখ্যার শীর্ষ ১ শতাংশের কাছে মোট সম্পদের ৪০ শতাংশের বেশি আছে, যেখানে নিচের ৫০ শতাংশের (৭০ কোটি মানুষ) কাছে আছে মাত্র ৩ শতাংশের মতো। আমরা অত্যন্ত দরিদ্র মানুষের একটি ধনী দেশ।

কিন্তু এই অসমতা জনমনে যে ক্ষোভ ও বিরক্তি তৈরি করেছে, তা প্রকৃত দোষীদের পরিবর্তে ভারতের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত। ১৭ কোটি মুসলমান, যারা জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ, তারা ওই আক্রান্তদের সামনের সারিতে রয়েছে। এই সংখ্যাগুরুবাদী চিন্তাধারা শ্রেণি-বর্ণ নির্বিশেষে, এমনকি প্রবাসী হিন্দু ভারতীয়দের মধ্যেও জেঁকে বসে আছে।
এ বছরের জানুয়ারিতে বিবিসি ইন্ডিয়া ‘দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ নামে একটি দুই পর্বের ডকুমেন্টারি সম্প্রচার করে। এটি ২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ থেকে শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত মোদির রাজনৈতিক অভিযাত্রার সন্ধান করে। ফিল্মটি প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ সরকারের একটা গোপন প্রতিবেদন প্রকাশ করে; ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে মোদির তত্ত্বাবধানে গুজরাটে সংঘটিত মুসলিমবিরোধী গণহত্যা সম্পর্কে একই বছরের এপ্রিলে তৈরি করে, গুজরাট রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের ঠিক আগে। প্রতিবেদনে মোদিকে ওই নৃশংসতার জন্য দায়ী করা হয়েছে।

কিন্তু ভারতে সে ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়; টুইটার ও ইউটিউবও মোদি আজ্ঞা মেনে এর সব লিঙ্ক সরিয়ে নেয়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ দিল্লি ও মুম্বাইতে বিবিসি অফিস রেইড দেয়; আয়কর কর্মকর্তারাও সেখানে অভিযান চালান। যেমন অক্সফ্যামের অফিসে হয়েছে; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অফিসে হয়েছে; অনেক বিরোধী রাজনীতিকের বাড়ি ও অফিসে হয়েছে। যেসব এনজিও সরকারের সঙ্গে তাল মেলায় না, তাদেরও এভাবে হেনস্তা করা হয়। পরিহাসজনক হলো, মোদি সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা আইনত খালাস পান। আর যেসব সরকারি কর্মী ও পুলিশ অফিসার তাঁকে ওই গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার সাহস দেখিয়েছিলেন, প্রমাণ ও সাক্ষ্য দিয়ে তাঁরা হয় কারাগারে আছেন অথবা ফৌজদারি বিচারের মুখোমুখি। এরই মধ্যে ওই ঘটনায় খুনের দায়ে দণ্ডিত অনেকেই জামিনে বা প্যারোলে বেরিয়ে গেছেন। গত আগস্টে, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে এ রকম ১১ জন কারাগার থেকে সাধারণ ক্ষমায় বেরিয়ে আসেন। ২০০২ সালের গণহত্যার সময় বিলকিস বানু নামে ১৯ বছর বয়সী এক মুসলিম মহিলাকে দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং তাঁর এক দিনের ভাতিজি, তাঁর ৩ বছরের মেয়েসহ পরিবারের ১৪ সদস্যকে হত্যা করার জন্য তারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছিল। কারাগারের দেয়ালের বাইরে ওই খুনি-ধর্ষকদের বীরের মতো বরণ করা হয় ফুলের মালা দিয়ে।


আমি যা বলেছি, তার কোনোটিই এই উপসংহারে আসতে দেবে না ভারতে বাকস্বাধীনতা নেই। কথা ও কাজের যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে সেখানে। যেমন সেখানে মূলধারার টিভি অ্যাঙ্কররা সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে অবাধে মিথ্যা বলতে পারেন; তাদের ওপর এমনভাবে দোষ চাপাতে পারেন, যাতে তাদের শারীরিক ক্ষতি বা বিনা দোষে কারাবাস নিশ্চিত করা যায়; কৃপাণধারী হিন্দু জনতা মুসলমানদের গণহত্যা ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ডাক দিতে পারে; দলিত এবং মুসলমানদের প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা যায়; প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা যায়; এবং এসবের ভিডিও অবাধে ইউটিউবে আপলোড করা যায়।
২০১৯ সালে মোদি ও তাঁর দল দ্বিতীয় মেয়াদে জয়লাভ করার কয়েক সপ্তাহ পরে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের রাজ্যত্ব ও আধা-স্বায়ত্তশাসন একতরফাভাবে কেড়ে নেওয়া হয়; দেশের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চলটির এসব অধিকার ভারতীয় সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছিল। এর পরই সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাস হয়। এই নতুন আইন স্পষ্টভাবে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক। এর সম্ভাব্য শিকার লোকেরা বেশিরভাগ মুসলমান, এখন তারা নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে আছে।

পোশাক আর দেখনদারি
গুজরাটের আহমেদাবাদে একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম হয়েছে, নাম নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম; এর আসন ক্ষমতা ১৩২,০০০। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সেখানে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নামক এক সমাবেশ হয়; যেখানে মোদি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এটি হয় সেই শহরে, যেখানে ২০০২ সালে মুসলমানদের দিনের আলোতে হত্যা করা হয়েছিল এবং মুসলমানরা এখনও ঘেটোতে বাস করে। তবে ট্রাম্প তাঁর বক্তৃতায় সহনশীল এবং বৈচিত্র্যময় হওয়ার জন্য ভারতের প্রশংসা করেছিলেন।

একদিন পরেই দিল্লিতে আসেন ট্রাম্প। রাজধানীতে তাঁর আগমন আরেকটি গণহত্যার সঙ্গে মিলে যায়। ঘটনাটা ঘটে মুসলিম-অধ্যুষিত একটি শ্রমজীবী পাড়ায়, ট্রাম্পের বিলাসবহুল হোটেল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে; এলাকাটি আমি যেখানে থাকি, সেখান থেকেও খুব দূরে নয়। স্বঘোষিত হিন্দুত্বের প্রহরীরা আবারও মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানেও হামলাকারীদের পাশে দাঁড়ায় পুলিশ।

গণতান্ত্রিক বিশ্বের রক্ষকদের কাছে এর কোনোটিই গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ ভারত বর্তমানে একটি উদীয়মান চীনকে ঠেকাতে পশ্চিমের একটা অস্ত্র; আর মুক্তবাজারে আপনি যুদ্ধবিমান বা বাণিজ্যিক বিমানের উদার ক্রয় আদেশের বিনিময়ে সামান্য দলবদ্ধ ধর্ষণ, লিঞ্চিং, জাতিগত নির্মূল অভিযান বা কিছু গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি উপেক্ষা করতেই পারেন।

বড় জোর কারা বিদ্রোহ; বিপ্লব নয়
ভারতে, অন্যান্য দেশের মতো, পরিচয়ভিত্তিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে পরিচয়ের রাজনীতিকেই সামনে আনা হচ্ছে। পরিচয় তথা আমাদের জাতি, বর্ণ, অ্যাথনিসিটি, লিঙ্গ বা যৌন পছন্দের কারণে আমরা যাঁরা ঐতিহাসিকভাবে নিপীড়িত হয়ে চলেছি, দাসত্ব-ঔপনিবেশিকীকরণ-অবজ্ঞা-অবলোপনের শিকার হয়েছি, তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে ওই সবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এখন সেই পরিচয়েই দ্বিগুণ উৎসাহে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছি।

নিঃসন্দেহে এটি ইতিহাসের একটি শক্তিশালী, বিস্ফোরক মুহূর্ত যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে বন্য ও তীব্র ক্ষোভ পুরোনো ও অনুমাননির্ভর ধ্যান-ধারণা ও আচরণ, ভারী ভারী শব্দ এবং কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতাপূর্ণ ভাষাকে, যা কখনও প্রশ্নের মুখে পড়েনি– তছনছ করে দিচ্ছে। এর তীব্রতা ও আকস্মিকতা একটি আত্মতুষ্টিতে বুঁদ থাকা বিশ্বকে সবকিছু পর্যালোচনার পাশাপাশি যে কোনো কিছু করার কিংবা প্রকাশ করার একটি ভালো উপায় খুঁজে বের করতে বাধ্য করছে। তবে পরিহাসজনক হলো, প্রায় অস্বাভাবিকভাবে এই ঘটনাটি, পরিশীলতার এহেন ধরনটি আমাদেরকে ধাপে ধাপে ফ্যাসিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
অর্থাৎ এই বিস্ফোরণের গভীর ও বৈপ্লবিক দিক যেমন আছে, তেমনি অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক দিকও রয়েছে। এটির চরম বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো বিতর্ককে কালিমালিপ্ত বা খারিজ করা সহজ। এটাই সেই শক্তি, যা অতি-ডানপন্থিরা নিজেদের সুসংহত করতে ব্যবহার করে। তবে এর নিচে চাপা পড়ার ভয়ে যাঁরা নিজেদের উদারপন্থি ও বামপন্থি বলে মনে করেন, তাঁরা প্রশ্নাতীতভাবে এই রূপান্তরকে মেনে নিতে রাজি নন। কারণ পরিচয়ের রাজনীতিতে প্রায়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থাকে, যাকে একটি কবজার সঙ্গে তুলনা করা যায়– যা যখন নিজের ওপর ভর করে, তখন সে যে জিনিসটিকে প্রতিরোধ করতে চায় তাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি এর প্রতিলিপিও তৈরি করে। আর এটি তখনই ঘটে, যখন কোনো জনগোষ্ঠীকে তার সাধারণ পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অণু-পরমাণুতে বিভক্ত করা হয়।

সংহতিও নির্ভেজাল নয়
তখন এমনকি এই ক্ষুদ্র পরিচয়গুলো– সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি ব্যবহার করে– বিশেষত বড় শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উঁচু-নিচু শ্রেণিসমৃদ্ধ একটি ক্ষমতা কাঠামো, একটি মাইক্রো-এলিট গোষ্ঠী তৈরি করে, যা অনিবার্যভাবে– যার বিরোধিতার জন্য পরিচয়সমূহের উদ্ভব, তারই অনুকরণে ওই একই ধরনের বর্জন, অবলোপন এবং শ্রেণিবিভাজনের খেলায় মত্ত হয়।
আমরা যদি নিজেদের ওপর সর্বদা ছড়ি ঘোরানো লোকদের চক্রান্তের ফসল হিসেবে প্রাপ্ত এহেন পরিচয়ের কারাগারে বন্দি করে রাখি, তাহলে আমরা বড়জোর কারা বিদ্রোহ করতে পারব; বিপ্লব নয়। এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কারারক্ষীরা সেখানে শিগগির উপস্থিত হবে। তারা সফলও হবে।

সম্প্রদায়, ধর্মীয় এবং বর্ণ, গোষ্ঠী, জাতি এবং লিঙ্গে নিজেদের আবদ্ধ করার পাশাপাশি পরিচয়ের সীমিতকরণ, সরলীকরণ এবং চাপাচাপি করে সকলকে এক পরিচয়ে আবদ্ধ করাও সংহতির পথে বাধা তৈরি করে। হাস্যকরভাবে, এটাই ছিল ভারতের হিন্দু বর্ণ ব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্য। একটি জনগোষ্ঠীকে উঁচু-নিচু শ্রেণিসমৃদ্ধ একটা কাঠামোর অলঙ্ঘনীয় বিভিন্ন বর্গে বিভক্ত করলে দেখা যাবে, এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ব্যথা অনুভব করতে সক্ষম হবে না। কারণ তারা নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষে লিপ্ত থাকবে।

বিগ টেক ও আধিপত্যবাদের মিলন
ইউএস এআইডির অর্থায়নে এবং অ্যামাজন, অ্যাপল, গুগল ও ওরাকলের মতো বিগ টেকের কল্যাণে রাষ্ট্র এখন আমাদের সামনে প্রায় অবতাররূপে আবির্ভূত হচ্ছে। ২০১৯ সালে ইউক্রেন সরকার স্মার্টফোনের জন্য একটি ডিজিটাল শনাক্তকরণ অ্যাপ ডিআইআইএ চালু করেছে। শতাধিক সরকারি পরিষেবা প্রদানের পাশাপাশি অ্যাপটি পাসপোর্ট, ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য আইডিও রাখতে পারে। এটি এক ধরনের উদ্যোগের মূলধন কেন্দ্র, যেখানে নাগরিকরা নিবন্ধন করতে এবং ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে।

রুশ আক্রমণ শুরু হওয়ার পর অ্যাপটিকে ‘যুদ্ধের জন্য পুনর্বিন্যাস’ করা হয়। এটি ব্যবহার করে নাগরিকরা যুদ্ধের বিষয়ে নিজেদের সর্বক্ষণ আপডেট রাখতে পারছে। উদ্বাস্তুরা নিজেদের নিবন্ধন করতে এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করতে এটি ব্যবহার করতে পারে। নাগরিকরা রাশিয়ান সৈন্যদের চলাফেরার তথ্য এবং ছবি আপলোড করতে পারে বলে জানা গেছে। সাধারণ নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত এক ধরনের রিয়েল-টাইম পাবলিক ইন্টেলিজেন্স এবং নজরদারি নেটওয়ার্ক।

কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে অ্যাপটিতে ইউক্রেনের নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য অ্যামাজনের সামরিক গ্রেডের হার্ড ড্রাইভে, যা ক্লাউডের সমতুল্য, স্থানান্তরের মাধ্যমে ইউক্রেনের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ক্লাউডে আপলোড করা হয়। এর ফলে আমাদের এডওয়ার্ড স্নোডেনের কথা মনে পড়ে, যিনি দেখিয়েছিলেন নজরদারি একটি দ্বিমুখী রাস্তা। আমাদের ফোন আমাদের অন্তরঙ্গ শত্রু হয়ে উঠতে পারে, তারা আমাদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তিও করে।

এখন আবার ‘গণতান্ত্রিক বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য’ ইউএস এআইডি ডিআইআই বা এর সমতুল্য কিছু অন্যান্য রাষ্ট্রেও নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, একবার ডিআইআইর মতো একটি অ্যাপকে ‘যুদ্ধের জন্য পুনঃউদ্দেশ্যমুখীন’ করা হয়েছে; এটি কি শান্তির জন্য ‘উদ্দেশ্যহীন’ হতে পারে? একজন অস্ত্রধারী নাগরিক কি অস্ত্রমুক্ত হতে পারে? একবার বেসরকারীকৃত ডাটা কি অ-বেসরকারি করা যায়?

ভারতও এই পথে অনেক দূর এগিয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে ভারতে একশ কোটি স্মার্টফোন ব্যবহারকারী থাকবে বলে অনুমান করা হয়েছে। একটি ভারত-নির্দেশিত ডিআইআই অ্যাপে ডাটার পরিমাণ কল্পনা করুন, তাও প্রাইভেট করপোরেশনের হাতে। অথবা অন্যদিকে কল্পনা করুন, এটি একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের হাতে এবং তার প্ররোচিত, অস্ত্রধারী সমর্থকদের হাতে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস করার পর একটা দেশ তার নিজের নাগরিকদের মধ্য থেকে লাখ লাখ ‘শরণার্থী’ তৈরি করে। দেশটি তাদের নির্বাসনে পাঠাতে পারছে না। তাদের সবার জন্য কারাগার তৈরি করার অর্থও নেই। কিন্তু ওই দেশের গুলাগ বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের প্রয়োজন হবে না। শুধু ওই শরণার্থীদের স্মার্টফোনগুলোর সুইচ বন্ধ করলেই হলো। তখন ওদের জন্য সব সেবা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে কার্যত অধিকারবিহীন বিশালসংখ্যক শ্রমিক দেশটি পেয়ে যাবে, যেখানে ন্যূনতম মজুরি, ভোটাধিকার, স্বাস্থ্যসেবা বা খাদ্য রেশন– কোনো কিছুর জন্যই সরকারকে চিন্তিত হতে হবে না।

ওই লোকদের কাগজে-কলমে উপস্থিতির দরকার নেই। কিন্তু ওই দেশের উন্নতির সূচক ধাইধাই করে বেড়ে যাবে। এটি বেশ দক্ষ এবং স্বচ্ছ একটা কার্যক্রম হতে পারে। এমনকি দেশটিকে মহান গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত হিসেবেও তুলে ধরা যেতে পারে।
তবে সেই দেশটির গন্ধ কেমন হতে পারে? এর স্বাদই বা কেমন লাগতে পারে? অচেনা কিছু? নাকি খুব চেনা?

অরুন্ধতী রায়: বুকারবিজয়ী ভারতীয় লেখক ও চিন্তক; সুইডিশ একাডেমিতে প্রদত্ত বক্তৃতার অংশবিশেষ ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন

আরও পড়ুন

×