- রাজধানী
- মার্কিন প্রতিবেদন নয়, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন
সমকালীন প্রসঙ্গ
মার্কিন প্রতিবেদন নয়, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন

সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশিত ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশ আমাদের দেশে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রতিবেদনটি বিশ্বের ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। দেশটি প্রতি বছরই এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। ৫০ বছর ধরে তারা এটি করে আসছে। এ প্রতিবেদনে তারা মানবাধিকার ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে থাকে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা, মিডিয়া সেন্সরশিপ, শ্রম অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে।
লক্ষণীয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলভিত্তিক প্রতিবেদনটিতে কোনো আইনি সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় না। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় হলো, মানবাধিকার পরিস্থিতির ভিত্তিতে প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর ক্রমতালিকাও প্রকাশ করা হয় না।
আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা শুরু হয়েছে ‘সর্বজনীন’ শব্দটি দিয়ে। কেননা, আমরা জানি, বিশ্বের অনেক দেশ সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে– কিছু নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে, যা বিশ্বের প্রতিটি মানুষ সর্বত্র ভোগ করার অধিকার রাখে। তিনি আরও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সেসব অধিকার রক্ষায় বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী মানুষের পাশে থেকে সব সময় সমর্থন করে যাবে। ব্যক্তির অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন একটি অধিকতর নিরাপদ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী বিশ্ব গড়ে তুলতে সহায়তা করে। মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার মধ্য দিয়ে দেশ হিসেবে আমাদের পরিচিতির মূল দিকটি ফুটে ওঠে। এখন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, সম্মান, শ্রদ্ধা ও অংশীদারিত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিয়মিতভাবে মানবাধিকারের বিষয়গুলো তারা তুলে ধরছে।
আমেরিকা যে গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের কথা বলেছে, সেগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। সেই বিবেচনায় বলা যায়, গণতন্ত্র মানে শুধু একটি নির্দিষ্ট বিষয় নয়। গণতন্ত্র তো সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা যে একেবারে শতভাগ সঠিক, তা নয়। তবে এখন পর্যন্ত মানুষ যত শাসন পদ্ধতি আবিষ্কৃত করেছে, গণতন্ত্র তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো। এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে রাষ্ট্রের যে প্রধান স্তম্ভ নাগরিক; সেই নাগরিকের মতামতের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি বাছাই করা হয়। সেই প্রতিনিধি বাছাইয়ের একটি পদ্ধতি হলো নির্বাচন। সেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া যদি সুষ্ঠু থাকে, তাহলে নাগরিকরা তাদের অধিকারের চর্চা করতে পারে। একইভাবে যাঁরা শাসন করবেন, তাঁরাও নাগরিকের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করবেন। এই দায়বদ্ধতার যে বিষয়টি, সেটি থাকলে দুর্নীতি কিছুটা কমে। আমেরিকার প্রতিবেদনেও দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে। শুধু তাদের প্রতিবেদনে দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে, এ জন্য নয়; আমাদের জন্যও এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে হবে। শাসন ব্যবস্থা যত স্বচ্ছ ও জবাবদিহির আওতায় আসবে, দুর্নীতি তত কমে আসবে।
এখন প্রতিবেদনের কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে কেউ কেউ সরব হচ্ছেন। যেমন এখানে ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলা হয়েছে। যদিও এটাকে ২০২২ সালের ঘটনাবলির আলোকে তৈরি করা একটি প্রতিবেদন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে কথা বলা অযৌক্তিক– এমন কথাও কেউ কেউ বলছেন। কিন্তু বিষয়টি তা নয়।
আমরা যদি দেখি, দেশের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে ২০১৮ সালে। এর পরে তো আর কোনো জাতীয় নির্বাচন হয়নি। তাই এখন আগামী নির্বাচন নিয়ে বলতে গিয়ে সর্বশেষ নির্বাচনের ঘটনা উদাহরণ হিসেবে টানলে তাতে দোষের তো কিছু নেই। সেটা যুক্তিসংগতই। আমরা যেটা সবাই বলে আসছি, আগামী নির্বাচনটি যাতে শান্তিপূর্ণ, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে শেষ হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের যাঁরা নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা বলেন– নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু শুধু তাঁরা বললেই তো হবে না। আমাদের যারা উন্নয়ন সহযোগী; আমাদের সঙ্গে সব সময় কোনো না কোনো বিষয়ে সম্পৃক্ত, তাদেরও তা স্বীকার করতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি কীভাবে করা যায়, যাতে সবকিছু শান্তিপূর্ণ হয়, সেটি নিয়েই আলোচনা হওয়া দরকার। বাংলাদেশে আগামীতে যে সরকার গঠিত হবে, তাদের এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে।
সারাবিশ্বেই এখন একটি বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে, যার একদিকে রয়েছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো– যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। অন্যদিকে রয়েছে যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে বিশ্বাস করে না। আমরা যদি নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করি, তার জন্য উপযুক্ত কাজও আমাদের করতে হবে। শুধু মুখে বললেই তো হবে না। এটি যদি করতে পারি, তবে আমরাও শান্তিপূর্ণভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারব।
আমাদের দেশের যে অবস্থা, এগিয়ে যাওয়া বা উন্নয়নের গতি ধরে রেখে এগিয়ে যেতে হলে তো বিনিয়োগ দরকার। আমাদের যারা উন্নয়ন সহযোগী-বন্ধুরাষ্ট্র, তাদের বিনিয়োগ ও সাহায্য-সহযোগিতা দরকার হবে। সেই সহায়তা পাওয়ার নিশ্চয়তা তো থাকতে হবে। এ জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো আমাদের কাছে গণতন্ত্রের যে প্রক্রিয়া বা দৃশ্যটি দেখতে চায়, এর নিশ্চয়তা আমাদেরই দিতে হবে।
এসব বিষয় বিবেচনা করেই কে কী বলল, তা না শুনে আমাদের জাতীয় স্বার্থে কিছু বিষয়ে অন্তত মনোযোগী হতে হবে। আমাদের নাগরিক স্বার্থ, রাজনৈতিক দলের স্বার্থ, উন্নয়নের স্বার্থ– সবকিছু মিলিয়ে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, গণতন্ত্র কোনো পারফেক্ট শাসন ব্যবস্থা নয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা যে ক’টি শাসন ব্যবস্থা আবিষ্কার করতে পেরেছি, তার মধ্যে এটি উত্তম। তর্কের খাতিরে আমাদের অনেকে বলছেন, গণতন্ত্র ভালো না। কিন্তু এর চেয়ে ভালো তবে কোনটা?
বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র আরও বেশি জরুরি এ জন্য যে, আমরা গণতন্ত্র ও সমান অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলাম। দেশ স্বাধীন করেছিলাম, সেটা তো এই গণতন্ত্রের জন্যই। যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমাদের পূর্বপুরুষরা লড়াই করেছিলেন, শহীদ হয়েছিলেন; সেই দায় থেকেই তো আমাদের গণতান্ত্রিক লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। তবেই তো শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হবে।
এম হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
মন্তব্য করুন