সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, নওগাঁয় আটকের পর র‍্যাবের ‘হেফাজতে’ সুলতানা জেসমিন নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। সুলতানা নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন। ২২ মার্চ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শহরের মুক্তির মোড় থেকে তাঁকে আটক করা হয়। গত শুক্রবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। র‍্যাব দাবি করেছে, প্রতারণার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। আটকের পর অসুস্থ হয়ে তিনি মারা গেছেন। স্বজনদের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতনের কারণে সুলতানার মৃত্যু হয়েছে।

১৭ বছর আগে সুলতানার সঙ্গে তাঁর স্বামীর বিয়ে-বিচ্ছেদ হয়। এর পর এক সন্তানকে অত্যন্ত কষ্ট করে বড় করছিলেন তিনি। শহরের একটা ভাড়া বাড়িতে থেকে ছেলেকে নিয়ে বসবাস করতেন। সেই ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। একজন সিঙ্গেল মায়ের সন্তানকে পড়াশোনা করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর লড়াই যে কত কঠিন, তা কি আমরা ভেবে দেখছি? সুলতানা ছিলেন ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের একজন সামান্য কর্মচারী। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অনিয়মের কোনো অভিযোগ কেউ করেননি। এমনকি একজন একাকী নারীর জীবনযাপন নিয়ে সমাজে কটু ইঙ্গিত করার লোকের অভাব না থাকলেও সুলতানার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এমন কোনো সংবাদ নজরে আসেনি। বরং সুলতানার পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে সহকর্মী সবাই একবাক্যে বলছেন– সুলতানা খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। যে সুলতানাকে স্বজন ও অফিসের সহকর্মীরা চিহ্নিত করছেন সহজ-সরল হিসেবে; তাঁকেই কিনা আটক হতে হলো র‍্যাবের অভিযানে!

সুলতানার মৃত্যুর প সংবাদমাধ্যমে এমন কোনো খবর এখনও প্রকাশ পায়নি, যাতে মনে হতে পারে, সুলতানা বিনা মামলায় র‍্যাবের হাতে আটক হওয়ার মতো অপরাধী। আটকের প সুলতানাকে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় নিজেদের হেফাজতে রেখেছিল র‍্যাব। অফিসে যাওয়ার পথে আটক হওয়া সুলতানা জেসমিনকে প্রায় ২৯ ঘণ্টা পর গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল।

সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা– কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করার ৩ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর পরিবার বা আইনজীবীর সঙ্গে আলাপের সুযোগ দিতে হবে। সুলতানা জেসমিনের ক্ষেত্রে এটি লঙ্ঘন করা হয়েছে। দেশে আইনের শাসন আছে– এটা শুধু মুখে বললে হবে না; কাজেও তার প্রতিফলন হতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা না হলে যে কোনো সময় যে কারও ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে।

সুলতানার মৃত্যুর পর এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারী যুগ্ম সচিব বলছেন, ‘সুলতানা হ্যাকারের কবলে পড়েছিলেন।’ আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘নওগাঁয় নিহত সুলতানা জেসমিনের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। ট্র্যাজিক কারণে তাঁর মৃত্যুর পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। এখানে আইনের অপব্যবহার হয়েছে।’ (সমকাল অনলাইন, ৩০ মার্চ ২০২৩)

এখানে লক্ষণীয়, সুলতানার হ্যাকারের কবলে পড়া, র‍্যাবের ‘হেফাজতে মৃত্যু’ এবং আইনমন্ত্রী যাঁকে বলছেন ‘দুর্ভাগ্যজনক’– এই বিষয়গুলো কী বার্তা দিচ্ছে? কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই সুলতানাকে আটক করা হয়েছিল। হেফাজতে নিয়ে সুলতানাকে নির্যাতন করা হয়েছিল। যার ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার যে ঘটছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল। বাংলাদেশের আইন বলছে, ‘হেফাজতে মৃত্যু’ অবৈধ। অর্থাৎ এর জন্য দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখন সুলতানার মৃত্যুর জন্য কাকে দায়ী করা হবে? তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে কিনা?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে র‍্যাবের কিছু বিপথগামী সদস্যের বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার খবর অজানা নয়। ক্রসফায়ার ইস্যুতে এই বাহিনী নিয়ে দেশে-বিদেশে মানবাধিকার সংস্থার সোচ্চার হওয়ার খবরও আমরা জানি। যুক্তরাষ্ট্রও এর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। মূলত তার পরই এই বাহিনীর মধ্যে সংস্কারের বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় এসেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণহানি অনেক কমে এলেও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা থেমে নেই– সুলতানা জেসমিন তার মর্মান্তিক উদাহরণ।

আমরা যেন একটি বৃত্তের মধ্যে বন্দি হয়ে আছি। যেন একই রকম ঘটনা আমাদের সামনে ঘটে চলেছে। পাল্টে যাচ্ছে শুধু চরিত্রের নাম।

প্রতিটি ঘটনায় আমরা প্রায় একই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে চলেছি। যেন কোনো ক্রুদ্ধ নিয়তি আমাদের বন্দি করে রেখেছে এই বৃত্তে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ থেকে আমাদের মুক্তি নেই। সত্যিই কি আমরা মুক্তি পাব না? শুধু একের পর এক ঘটনায় হা-হুতাশ, প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেই যাব? 

এহ্‌সান মাহমুদ: সমকালের সহসম্পাদক