রাজধানীর দুই এলাকা– সিদ্দিকবাজার ও সায়েন্স ল্যাবরেটরির দুই ভবনে পরপর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল আশপাশও। ধ্বংসযজ্ঞ ও হতাহতের ঘটনায় তৈরি হয় আতঙ্ক। এর মধ্যে সিদ্দিকবাজারের ক্যাফে কুইন ভবন ঘিরে তদন্তে বহু অনিয়ম পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সায়েন্স ল্যাবের ঘটনার কারণও চিহ্নিত করেছেন তদন্তকারীরা। গত মাসের শুরুতে ওই দুই বিস্ফোরণে ২৯ জন নিহত হন।

ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় দুটি মামলা করা হয়। একটি মামলার তদন্ত করছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম ও আরেকটি নিউমার্কেট থানা পুলিশ।

৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারের ১৮০/১ নম্বর হোল্ডিংয়ের সাত তলাবিশিষ্ট ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্তের অংশ হিসেবে তিতাস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে পুলিশ। আদালতের অনুমতি দেওয়া ইস্যু করা ওই চিঠিতে তারা ক্যাফে কুইন ও আশপাশ এলাকার তিতাস গ্যাসের সব লাইনের উৎস জানতে চেয়েছে। টাকার লোভে ভবন মালিক ক্যাফে কুইনের বেজমেন্ট অবৈধভাবে ভাড়া দেন। এতে তৈরি হয় ‘মৃত্যুফাঁদ’।

একসময় বেজমেন্ট গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে ভবনের অন্যতম মালিক দুই ভাই ক্যাফে কুইন ঘিরে নানা অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন। এদিকে ৫ মার্চ সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে বিস্ফোরণের ঘটনার প্রাথমিক উৎস সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে পুলিশ।

সিটিটিসির প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের তদন্ত চলছে। প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু আলামত পাওয়া গেছে।

পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ চৌধুরী সমকালকে বলেন, সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে গ্যাস আর স্যুয়ারেজ লাইন একাকার হয়ে যায়। নিচতলা থেকে স্যুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস তৃতীয় তলায় ওঠে। এর পর সেখান থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। সিদ্দিকবাজারের ঘটনায় তিতাসকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, ক্যাফে কুইন ভবনের মালিক দুই ভাই ওয়াহিদুর রহমান ও মতিউর রহমান এবং তাঁদের ভাড়াটিয়া আব্দুল মোতালেবকে হেফাজতে এনে এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। বাড়ির দুই মালিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, একসময় ক্যাফে কুইন ভবনটি টিনশেড ছিল। তখন ওই ভবনে একটি রেস্টুরেন্ট চলছিল। সেখানে একটি বাণিজ্যিক লাইনের সংযোগ ছিল। পরে যখন বহুতল ভবন করা হয়, তখন বাণিজ্যিক গ্যাসের লাইনটি অন্যের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। আর নতুনভাবে আবাসিক গ্যাসের লাইন নেওয়া হয়। তবে পুরোনো বাণিজ্যিক গ্যাসের লাইনের পাইপ ওই ভবনে সচল ছিল কিনা, সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত নন দুই ভাই।

তাঁদের ভাষ্য, এসব বিষয় একসময় তাঁদের বাবা দেখভাল করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁরা বাড়ির বিষয়গুলোর দিকে নজর দেন। প্রতি মাসে পুরো ভবন থেকে ভাড়া তুলে মায়ের হাতে দেন। বিস্ফোরণের পর থেকে তাঁদের মা রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

একজন উচ্চপদের কর্মকর্তা জানান, ওই ভবনের মালিক রেজাউর রহমান একসময় ক্যাফে কুইন নামে একটি রেস্তোরাঁ খুলেছিলেন ওই ভবনে। এ কারণে ভবনটি ‘ক্যাফে কুইন’ নামে সবাই চেনে। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে ভবনের মালিক। তাঁদের মধ্যে মশিউর রহমান ও তাঁর এক বোন বিদেশে থাকেন।

বিস্ফোরণের সময় দুই ভাই ওয়াহিদুর ও মতিউর তাঁদের ফ্ল্যাটে ছিলেন। তবে পরিবারের কোনো সদস্য হতাহত হননি। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা স্বীকার করেন, অনুমতি না নিয়ে ভবনের বেজমেন্ট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। বেজমেন্টটি আগে গাড়ির গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশ স্যানিটারি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে মাসে ৪০ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়।

তাঁরা জানান, এর আগে কিছুদিন বেজমেন্টটি করিম পাইপের গুদাম হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। দুই ভাই আরও দাবি করেন, প্রথমে পাঁচ তলার অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। পরে ভবনটি ১০ তলাবিশিষ্ট করার অনুমতি পান তাঁরা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ১০ তলার অনুমতি প্রদান-সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। তাঁদের ভাষ্য, বিধ্বস্ত ভবনে তাঁরা যেতে পারছেন না। সেখানে অনেক কাগজপত্র আটকা আছে।

তবে তদন্তসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অবৈধভাবে হয়তো সাত তলাবিশিষ্ট ভবনটি তৈরি করা হয়। তবে ভবনের মালিক দুই ভাই এই দুর্ঘটনার জন্য নিজেদের দায় স্বীকার করছেন না। তাঁরা বলছেন, কয়েক মাস আগে বাসায় লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় তাঁরা তিতাসে অভিযোগ করেন। পরে তিতাস কর্তৃপক্ষ লাইন ঠিক করে দিয়েছে। পুলিশ বলছে, লাইনে গ্যাসের চাপ বাড়ায় পুরোনো লাইনের গ্যাস জমা হয়েছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে বেজমেন্ট খোলামেলা থাকলে এত বড় বিস্ফোরণ ঘটত না।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সায়েন্স ল্যাব ও সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের পর জনমনে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তাই কোন স্থান থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত নিবিড়ভাবে তদন্ত করে তা চিহ্নিত করতে চান তাঁরা। এ ছাড়া এই ঘটনার জন্য দায়ীদের শনাক্ত করা হবে। এ কারণে আদালতের অনুমতি নিয়ে ক্যাফে কুইন ও আশপাশের ভবনে কোন কোন সূত্র থেকে গ্যাস লাইন গেছে, তা আগে চিহ্নিত করার দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত্র বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন তাঁরা। কারণ ওই ভবনের স্যুয়ারেজ ও পানির ট্যাঙ্কে এখন পর্যন্ত ত্রুটি পাওয়া যায়নি।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, বেজমেন্টে যে কোনো উপায়েই গ্যাস জমেছিল। সেখানে বৈদ্যুতিক সার্কিট বা অন্য কোনো উপায়ে স্পার্ক থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিস্ফোরণের মাত্রাও ছিল ব্যাপক। এসি থেকে দুর্ঘটনা ঘটেনি। সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। এ ছাড়া সায়েন্স ল্যাবের বিস্ফোরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রসহ নিহত হন চারজন।

জানা গেছে, আলোচিত দুই বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে পুলিশ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের মতামত নেবে। আগামীতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে করণীয় সম্পর্কে প্রস্তাবও থাকবে।