
রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনের প্রকল্পে প্রকল্পে লেগেছে ভজকট। সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা, বিভিন্ন সংস্থার আন্তঃসমন্বয়ে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, সরকারের অনুমোদনসহ সব ধাপ পেরিয়ে নির্মাণকাজ শুরুর পর ধরা পড়ছে– এক প্রকল্প আরেকটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে আটকে যাচ্ছে কাজ, খরচও বাড়ছে। হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্পের ভিড়ে যানজট বাড়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
উন্নয়ন প্রকল্পের জট ছোটাতে গত ২২ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) পরিচালনা পরিষদের সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে সমন্বয় কমিটি করা হয়। গতকাল সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ডিটিসিএ ভবনে কমিটির প্রথম বৈঠক হয়েছে। তবে বৈঠক থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারি সংস্থাগুলোর মত নিয়েছে কমিটি।
সভার কার্যপত্র সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর হয়ে চিটাগং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে আপত্তি রয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। ১২ বছর আগে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) এই এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরু করে সেতু বিভাগ। এতে খরচ হচ্ছে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।
এক যুগ পর এসে দক্ষিণ সিটি বলছে, নকশা অনুযায়ী এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প তেজগাঁওয়ে এফডিসি রেলক্রসিং থেকে হাতিরপুল হয়ে পলাশীর দিকে গেলে যানবাহনের চাপ বহু গুণ বাড়বে। পদ্মা সেতুমুখী গাড়ি পলাশী হয়ে হানিফ ফ্লাইওভারে উঠতে চাইবে। এতে যানজট বাড়বে। এরপরও যদি পলাশীমুখী র্যাম্প করা হয়, তবে তা থেকে আদায় করা টোলের ভাগ চায় দক্ষিণ সিটি। সমন্বয় কমিটির বৈঠকে ছিলেন দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, তিনি প্রশ্ন তোলেন সব সংস্থাকে না জানিয়ে কীভাবে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়?
গণপরিবহন ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক সমকালকে বলেন, এই প্রশ্ন প্রকল্প নেওয়ার সময়ই তোলা উচিত ছিল। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এক প্রকল্পের সঙ্গে আরেকটি সাংঘর্ষিক। সরকারি সংস্থাগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে খুবই আগ্রহী। যে যার মতো প্রকল্প অনুমোদন করাচ্ছে।
আরেক সংস্থার কথা শুনছে না। প্রকল্পের জট নিরসন পরিকল্পনা কমিশনের কাজ। কেউ কিছু দেখছে না, যে যার লাভ নিয়ে চলে যাচ্ছে।
ঢাকার ১৭ প্রকল্পের একটি আরেকটির সঙ্গে কতটা সাংঘর্ষিক তা নিয়ে ২০১০ সালে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন ড. সামছুল হক। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পরিকল্পনা কমিশনসহ সব জায়গায় প্রতিবেদন দিয়েও কাজ হয়নি। মগবাজার ফ্লাইওভার, হানিফ ফ্লাইওভারের কারণে বিআরটি, মেট্রোরেলের মতো গণপরিবহন আটকে গেছে, বেড়েছে যানজট।
পিপিপিতে নির্মাণাধীন আরেক প্রকল্প হাতিরঝিল-রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ে পাঁচ বছর আগে সরকারের অনুমোদন পেয়েছে। সাড়ে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ২ হাজার ৯৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে চীনের দুই প্রতিষ্ঠান। ৩ হাজার ৩০৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পের বাকি অর্থায়ন করছে সরকার। গত বছরের জানুয়ারিতে কাজ শুরু করতে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে চুক্তি করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
বৈঠকে ছিলেন উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলামও। উত্তর সিটি জানায়, হাতিরঝিল-রামপুরা-আমুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের খুঁটি (পিয়ার) রামপুরা খালের পাড় ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে। এতে পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হবে। যানজট নিরসনে রামপুরায় ইউলুপ নির্মাণ করেছে উত্তর সিটি। এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নামবে হাতিরঝিলে। ওই র্যাম্পের কারণে হাতিরঝিলের ট্রাফিক সার্কুলেশন পরিকল্পনা ব্যাহত হতে পারে।
অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, পিপিপির বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণ ঠিকাদার নন। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সার্বভৌম চুক্তি করে বাংলাদেশ। তাই পিপিপি প্রকল্পের অদলবদল হলে আন্তর্জাতিক আদালতের মামলায় পড়ে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে। পলাশীর র্যাম্প থেকে এক্সপ্রেসওয়ের বিনিয়োগকারীর ১৮ শতাংশ রাজস্ব আসবে। ওই র্যাম্পের কারণে যানজট বাড়বে কিনা– তা প্রকল্প গ্রহণের সময়ই বোঝা উচিত ছিল। কেমন সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে– সরেজমিন কাজ হয়েছে, নাকি ঘরে বসে সমীক্ষা করা হয়েছে?
বিমানবন্দর-কুতুবখালী এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে আপত্তি তুলেছে উত্তর সিটিও। সংস্থাটি জানিয়েছে, এক্সপ্রেসওয়ের একটি র্যাম্প ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কাকলী ইন্টারসেকশনে নামবে। এতে যানজট বাড়বে। উত্তর সিটি মিরপুরের আনসার ক্যাম্প থেকে কচুক্ষেত পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিপিপিও তৈরি। এই প্রকল্পে আনসার ক্যাম্প থেকে সৈনিক ক্লাব পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। এর সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ তৈরি করতে সভা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এক্সপ্রেসওয়ের টোল থেকে হিস্যা চায় উত্তর সিটিও।
এফডিসি রেলক্রসিং থেকে হাতিরঝিলের ওপর নিয়ে যাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প। গতকালের বৈঠকে রাজউক জানায়, ৪২ পিলার হাতিরঝিলের পানিতে তৈরি হবে। এতে লেকের সৌন্দর্য বিঘ্নিত হবে। এসব খুঁটির নকশায় পর্যালোচনায় যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি বলেন, লেকের ক্ষতি তো হবেই। এগুলো প্রকল্প অনুমোদনের সময়ই দেখা উচিত ছিল।
এফডিসি মোড়ে মেট্রোরেলের এমআরটি-৫ দক্ষিণ লাইনের নির্মাণ নিয়েও সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়েছে। গতকালের বৈঠকে মেট্রোরেলের নির্মাণকারী সরকারি কোম্পানি ডিএমটিসিএল জানায়, সমস্যার নিরসন হয়েছে। তবে এক্সপ্রেসওয়ের বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
এমআরটি-৫ দক্ষিণ লাইন নির্মাণে তেজগাঁওয়ের সড়কে গভীর খননকাজ চলবে। এতে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ বন্ধ থাকবে ২৩৮ দিন। ৬০ লাখ ডলার বা ৬৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চায় এক্সপ্রেসওয়ের চীনা বিনিয়োগকারীরা। গতকালের বৈঠকে জানানো হয়, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কত হবে এবং ক্ষতিপূরণ কে দেবে– তা নির্ধারণে কাজ করছে পিপিপি কর্তৃপক্ষ।
টঙ্গী থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন নির্মাণ করেছে রেলওয়ে। দেড় হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের পথে বাধা হয়েছে খিলগাঁও থেকে মালিবাগ বাজার পর্যন্ত দক্ষিণ সিটির ১ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক। গতকালের বৈঠকে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই সড়ক রেলের জমিতে তৈরি হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন নির্মাণের পর ওই সড়ক বন্ধ হবে। এতে আপত্তি জানান মেয়র। তখন রেল বিকল্প সড়কের প্রস্তাব করে।
এ প্রসঙ্গে সামছুল হক সমকালকে বলেন, রেলের প্রকল্প শুরুর আগে থেকেই দক্ষিণ সিটির সড়ক রয়েছে। রেলের জমিতে সড়ক নির্মাণের সময় বিষয়টি ফয়সালা করা উচিত ছিল সিটি করপোরেশনের। কিন্তু সমস্যা হলো, জবাবদিহি নেই বলে যে যার মতো কাজ করে।
যানজট নিরসনে ২০১৫ সালে প্রণীত মহাপরিকল্পনায় ঢাকাকে ঘিরে সার্কুলার রুট বা বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। সওজ সেতু ও উড়াল সড়কসহ ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সার্কুলার রুট নির্মাণে সমীক্ষা ও নকশা করেছে। দুই সিটি করপোরেশনই বৈঠকে জানায়, সার্কুলার রুটের কিছু অংশ তাদের জমির ওপর দিয়ে যাবে। তাই সেখানে তারাই সড়ক নির্মাণ করবে।
সার্কুলার রুটের পূর্ব অংশ (ইস্টার্ন বাইপাস) নির্মাণ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সংস্থাটি বৈঠকে জানায়, ২০১৭ সালেই সমীক্ষা হয়েছে। তবে ঢাকার চারপাশের নদী রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের ঋণে আরেকটি প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন চলছে। তা শেষে আবার ইস্টার্ন বাইপাসের ডিপিপি পাঠাবে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বৈঠকে বলেন, যানজট নিরসনেই প্রকল্প নিয়েছে সরকার। এগুলোর অবস্থান নির্ধারণে অংশীজনের মত ও সমন্বয় জরুরি। তিনি জানান, সব সংস্থার মতামত সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নেবে কমিটি। বৈঠকে ছিলেন রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর, সড়ক পরিবহন সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী, সেতু সচিব মনজুর হোসেন, পিপিপির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মুশফিকুর রহমান, রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা প্রমুখ।
মন্তব্য করুন