রাজধানীতে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীর সংঘর্ষের সময় বিআরটিসির বাসে আগুন দেওয়া সাদা শার্ট পরা যুবককে খুঁজছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। এদিকে, গত মঙ্গলবার ধানমন্ডিতে সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় দুটি এবং নিউমার্কেট থানায় একটি মামলা করে। এজাহারে পুলিশের ওপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ এবং নাশকতার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনটি মামলাতেই আসামি হয়েছেন বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, মীর শরাফত আলী সপু, আব্দুস সালাম, ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। তিন মামলায় এজাহারভুক্ত মোট আসামি ৭৮ জন। আবার একই ব্যক্তিকে তিন মামলাতেই আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা ৪০০ থেকে ৫০০।

ওই তিন মামলায় ৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ধানমন্ডি থানায় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবিসহ ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বুধবার তাঁদের মধ্যে ১২ জনকে আদালতের মাধ্যমে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অন্যদিকে, নিউমার্কেট থানা পুলিশ ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক সবুজ মোল্লাসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের আটজনকে এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

সরকারের পদত্যাগের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণে পদযাত্রা গত মঙ্গলবার বিকেলে ধানমন্ডি আবাহনী ক্লাব মাঠের সামনে থেকে শুরু হয়। এ পদযাত্রা কাঁটাবন গিয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ধানমন্ডি ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে পদযাত্রাকে আটকে দেয়। পুলিশের দাবি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত কর্মসূচি করার অনুমতি ছিল তাদের। যে কারণে তাদের আর এগোতে দেওয়া হয়নি।

দায়িত্বশীল নেতারা সেখানেই কর্মসূচি সমাপ্তির ঘোষণা করেন। তবে একদিকে পুলিশের ব্যারিকেড থাকায় নেতাকর্মীরা বের হতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা তাঁদের হাতে থাকা লাঠি, ইটপাটকেল পুলিশকে লক্ষ্য করে ছুড়তে থাকেন। এক পর্যায়ে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। সংঘর্ষের সময় ল্যাবএইড মোড়ে যাত্রীবাহী বিআরটিসির দোতলা বাস ভাঙচুর ও তাতে অগ্নিসংযোগ করে নেতাকর্মীরা। ভাঙচুরের ঘটনার একাধিক ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যায়, তরুণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করছে। দরজা লাগানো বাসের ভেতরে আতঙ্কিত যাত্রীরা। পরে যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পর বাসটিতে আগুন লাগানো হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বাস ভাঙচুরের সময় পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল না। তবে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ পৌঁছানোর পরপরই নেতাকর্মীরা দৌড়ে পালিয়ে যায়। একাধিক ব্যক্তি বাসটি ভাঙচুর করলেও অগ্নিসংযোগ করেছে সাদা শার্ট পরা এক যুবক। এ বিষয়ে ঘটনাস্থলের পাশের হ্যাপি আর্কেড শপিংমলের দু’জন নিরাপত্তাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সমকালকে বলেন, মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় এ এলাকার সব মার্কেট বন্ধ ছিল। গাড়ি ভাঙচুরের সময় তাঁরা নিরাপদ স্থানে চলে যান। সেখান থেকে তাঁরা এক সাদা শার্ট পরিহিত যুবককে দেখেছেন গাড়িতে আগুন দিতে। ওই যুবক যাত্রী নামিয়ে বাসে আগুন দেন। তবে এ ঘটনা উদ্ঘাটনে এলাকার কোনো সিসিটিভি ফুটেজ কিংবা কোনো গণমাধ্যমের ফুটেজ পাওয়া যায়নি। মার্কেটের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব সিসি ক্যামেরা থাকলেও তা রাস্তার দিকে নেই।

ধানমন্ডি থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া সমকালকে বলেন, বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বাস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। আগুন দেওয়া যুবকের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। হামলাকারী ও অগ্নিসংযোগকারীদের খুঁজছে পুলিশ।

ধানমন্ডি থানার এজাহার দুটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুটিতেই প্রায় অভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। তাতে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বেআইনিভাবে সমবেত হয়ে পুলিশের সরকারি কাজে বাধাদান, পুলিশের ওপর আক্রমণ, সরকারকে উৎখাত ও জনসাধারণের জানমালের ক্ষতিসাধন, গণপরিবহন ভাঙচুর ও ত্রাস সৃষ্টি করে নাশকতা কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। অবশ্য ককটেল বিস্ফোরণের কথাও বলা হয়েছে একটি মামলায়। দুটি মামলাতেই এজাহারের ৫২ জন করে আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে, নিউমার্কেট থানায় করা মামলায় এজাহারে আসামি সংখ্যা ৪৬ জন। তিন মামলার আসামির মধ্যে রয়েছেন– বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, দলটির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দীন অসীম, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম ও আবুল খায়ের ভূঁইয়া, যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান সালাউদ্দীন টুকু, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মীর শরাফত আলী সপু, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া, যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসাহাক সরকার, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রমুখ।

সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দিয়ে বলেছেন, বিএনপিকে ঠান্ডা মাথায় নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে, বিএনপির আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে হবে। ওবায়দুল কাদেরসহ তাঁদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এই ধরনের হুংকারের পর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় তাঁদের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় বিনা উস্কানিতে হামলা করেছে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের বিশেষ গুঁড়িয়ে দেওয়া বাহিনী। অতীতের মতো আবারও বাসে আগুন দিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর পুরোনো নাটক শুরু করেছে তারা।

পদযাত্রার ঘটনা তুলে ধরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম বলেন, এ হামলা পূর্বপরিকল্পিত। পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাসের শেল আর রাবার বুলেটে যখন বিএনপি নেতাকর্মীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে পুলিশের পাহারায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বাসে অগ্নিসংযোগ করেছে বলে দাবি করেন তিনি।