- রাজধানী
- নিউমার্কেট এলাকার আতঙ্ক তারা
নিউমার্কেট এলাকার আতঙ্ক তারা

ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ বহুদিনের। নিউমার্কেটসহ আশপাশের সব মার্কেট থেকেই নিয়মিত চাঁদাবাজি করেন তাঁরা। এ ছাড়াও লোকজনকে তুলে এনে হলে আটক করে টাকা আদায়ের অভিযোগ শোনা যায় মাঝেমধ্যে। চাঁদার দাবিতে গত শুক্রবার এক ছেলেকে ধরে এনে ঢাকা কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসে মারধর করা হয়। ওই ছেলের ফুফা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানার পর ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।
এর আগের দিন বৃহস্পতিবার এই ছাত্রাবাসে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে আটক করে টাকা আদায়ের জন্য নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসম্পাদক জনি হাসান ও সাবেক উপক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক এস এম শফিককে শুক্রবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চাঁদাবাজির মামলায় রিমান্ডে তাঁরা।
আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, চাঁদাবাজি ও নির্যাতন এখানে নিত্যদিনের ঘটনা। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি ঘটনা সামনে আসে। জানা যায়, পুরো ছাত্রাবাসের নেতৃত্ব দেন ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জসীম উদ্দিন। ছাত্রত্ব না থাকলেও তিনি ছাত্রাবাসের ১০৭ নম্বর কক্ষে থাকেন। তিনি ছাত্রলীগের কমিটিতে পদপ্রত্যাশী এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী। অপকর্মের ঘটনাগুলোতে সরাসরি না থাকলেও পেছন থেকে তিনিই ইন্ধন দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে নির্যাতনের শিকার মেহেদী হাসানের চাচাতো ভাই আবদুস সবুর অভিযোগ করেছেন, জসীম উদ্দিন মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জসীম।
শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, জ্যেষ্ঠরা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের নেতৃত্ব দেন পদপ্রত্যাশী মো. বেলাল হোসেন, উত্তর ছাত্রাবাসের ছাত্রলীগকর্মী ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শাহরিয়ার হাসনাত জিয়ন ও ১১১ নম্বর কক্ষের ইংরেজি বিভাগের রফিকুল ইসলাম, শেখ হেলাল, দক্ষিণ হলের শেখ মিঠুন ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাসের আবু জাফর সূর্য। তাঁদের সঙ্গে আছেন ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের তারিফ আনাম, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ইমতিয়াজ হাসান পিয়াশ, মেহরাব হোসেন সিয়াম, ইংরেজি বিভাগের তাসিন নাফিউ অর্ণব ও ১১১ নম্বর কক্ষের মো. রমজান এবং ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের জুনাইদ বোগদাদী প্রধান।
মামলা তুলে নেওয়ার হুমকির অভিযোগের বিষয়ে জসীম উদ্দিন বলেন, ‘মেহেদী হাসানের বড় ভাই আমাদের ক্যাম্পাসের জুনিয়র। আমি ভালোমন্দ জানতে ওনাকে ফোন দিয়েছিলাম। আমি ঘুমে থাকায় ঘটনা এত বড় হয়েছে।’
একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার জনি হাসান কলেজের ইন্টারন্যাশনাল হলে থাকেন। ক্যাম্পাসে মাদক বাণিজ্য ও ছিনতাইয়ের অন্যতম হোতা তিনি। নিজের কক্ষে মদপান করেন। বহিরাগতদের আনাগোনা রয়েছে মদের আড্ডায়। নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের যেসব শিক্ষার্থী ছিনতাইয়ে জড়িত, তাঁদের কাছ থেকে টাকার ভাগ পান তিনি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি করতে দল নিয়ে হাজির হন তিনি। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তুলে এনে আটকে রাখা হয় হলে। টাকা না দেওয়া পর্যন্ত চলে শারীরিক নির্যাতন। গ্রেপ্তার শফিকও থাকেন ইন্টারন্যাশনাল হলে। ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করেন। বিভিন্ন জনের পাওনা টাকা আদায়ে চুক্তিতে কাজ করেন শফিক।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন
সমকালকে বলেন, অপরাধের প্রতিটি ঘটনায় আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। ঢাকা কলেজের এই ঘটনায়ও ব্যবস্থা নেব।
সার্বিক বিষয়ে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইউসুফ সমকালকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে কাজ করছে, সেভাবেই করবে। এখানে আমাদের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। আমরা চাই ক্যাম্পাসের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকুক।’
পাওনা টাকা আদায়ের জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মেহেদী হাসান ও কর্মচারী তৌকিরকে অপহরণের পর বৃহস্পতিবার আবাসিক হোটেলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। গভীর রাতে তৌফিককে ছেড়ে দেওয়া হলেও নির্যাতন চলতে থাকে মেহেদীর ওপর। শুক্রবার দুপুরে অভিযুক্তরা নিউমার্কেট এলাকায় রেখে গেলে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে জনি হাসান, শফিকসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে নিউমার্কেট থানায় মামলা করেন। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় ১০-১২ জনকে।
মেহেদী হাসান সমকালকে বলেন, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। মার্কেট ও বিভিন্ন এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করে তাঁর প্রতিষ্ঠান। ঢাকা কলেজের ৯ শিক্ষার্থী তাঁর প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করতেন। এর মধ্যে পাঁচজন সরাসরি কাজ করতেন তাঁর অধীনে। সর্বশেষ তাঁরা আনুমানিক তিন মাস আগে একটি প্রকল্পে কাজ করেছেন। হাজিরা হিসেবে ৪০-৪৫ হাজার টাকা পান তাঁরা। তাঁদের ধারণা, ওই টাকা তিনি (মেহেদী) আত্মসাৎ করেছেন। কিন্তু প্রকল্পের বিল না পাওয়ায় তাঁদের টাকা পরিশোধ করতে পারেননি তিনি। ওই টাকার দাবিতে বিভিন্ন সময় তাঁরা হুমকি দিয়ে আসছিলেন। বিভিন্ন সময় ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের দিয়ে টাকা আদায় করবেন বলে হুমকি দিতেন।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার বছিলা এলাকা থেকে তাঁদের সিসি ক্যামেরাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম খুলে আনেন আসামিরা। এর পর তাঁকে ফোন করে সেগুলো কলেজ থেকে নিয়ে যেতে বলা হয়। তিনি প্রথমে কর্মচারী তৌফিককে পাঠান। কলেজে যাওয়ার পর তৌফিককে আটকে রেখে মারধর করা হয়। পরে তাঁকে ডাকা হয় কলেজে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি যান। এর পরই তাঁকে একটি কক্ষে আটকে চাঁদা দাবি করেন তাঁরা। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে হকিস্টিক ও রড দিয়ে মারধর শুরু হয়। সারারাত তাঁকে হলে আটকে রেখে ৩ লাখ টাকার চাঁদা দাবিতে শারীরিক নির্যাতন করা হয়।
নিউমার্কেট থানার ওসি শফিকুল গণি সাবু সমকালকে বলেন, চাঁদাবাজি মামলায় দুই ছাত্রলীগ নেতাকে শনিবার এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কী তা বিস্তারিত তদন্তের স্বার্থে জানাতে রাজি হননি তিনি। রিমান্ড শেষ হওয়ায় আজ তাঁদের আদালতে হাজির করা হবে।
মন্তব্য করুন