
সম্প্রতি রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড চলাকালে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ কিংবা বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হাতিরঝিল থেকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিপর্যয়ে অসহায়ত্বের কথা। এ যেন ‘লালন মরল জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা’। আগুন নেভাতে কি এই শহরে পানির অভাব হওয়ার কথা ছিল? ঢাকা শহরজুড়ে এবং এর আশপাশে এত খাল, বিল, ঝিল, নদী ছিল– সেগুলো গেল কোথায়?
মাত্র তিন দশক আগেও ঢাকা শহরজুড়ে ৫০টির বেশি খাল, লেক, জলাভূমি ছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। ধানমন্ডি-পরিবাগ-গুলশান-বনানী-মহাখালী-বেগুনবাড়ী খাল এই শহরে শিরার মতো জড়িয়ে থেকে বালু নদীতে সংযুক্ত হতো। শহরের পানি নিষ্কাশন থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও এর গুরুত্ব ছিল অনেক। এর বাইরে ছিল দেগুন-ইব্রাহিমপুর-কল্যাণপুর খাল, যেটি তুরাগ নদে সংযুক্ত করে শহরের নিষ্কাশন এবং জল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহায়তা করত। এ ছাড়া সেগুনবাগিচা-ধোলাইখাল বালু নদী ও বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রবাহিত হতো। এই খালগুলো ঢাকা শহরকে পানি প্রবাহের মাধ্যমে প্রাণপ্রাচুর্য দান করেছিল। শহরে বহমান খাল, অবস্থিত ঝিল, পুকুরগুলো পানির উৎস হিসেবে যেমন কাজ করত, তেমনি এসব প্রাকৃতিক প্রবাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
সময়ের সঙ্গে শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো যেমন কমছে, তেমনি শহরকে ঘিরে রাখা নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এসব প্রাকৃতিক প্রবাহ মানুষ ভরাট করতে শুরু করে তাঁদের আবাসস্থল, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চলাচলের জন্য স্থাপনা নির্মাণ তৈরিতে। পাশাপাশি এসব স্থাপনা থেকে সৃষ্ট বর্জ্য আশপাশের জলাশয়ে ফেলার কারণে সেগুলো ভরাট হয়ে যেতে থাকে। এ জন্য দখলদারিত্ব সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মনে করা হয়। দেশের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এই শহরে সারাদেশ থেকে লোক ছুটে এসেছে জীবন-জীবিকা ও নানা কাজের তাগিদে। তাই এই নগরী এখন বিশ্বে কয়েকটি মেগা সিটির একটি, যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বহনক্ষমতা অতিক্রম করেছে অনেক আগে। এই শহরে মানুষ বাড়ছে আর বসবাসকারীদের প্রয়োজনে বাড়ছে আবাসন, রাস্তাঘাট, পরিবহন ব্যবস্থা। মানুষের চাহিদা মেটাতে গিয়ে এই নগরী হয়ে গেছে কংক্রিটের জঙ্গল।
শহরের বুক চিরে বয়ে চলা খালগুলো হারিয়ে যাওয়ার পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে মূল হলো এত মানুষের জন্য আবাসন, রাস্তাঘাট, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নির্মাণ এবং এই নির্মাণযজ্ঞ থেকে যে আবর্জনা সৃষ্টি হচ্ছে তার শেষ গন্তব্য জলাশয়। এ শহরের বেশ কিছু খাল এখন কালভার্টে বাক্সবন্দি। এসব কালভার্টবন্দি খালে প্রায়ই আবর্জনা, জঞ্জাল জমে প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, আবার এর পানির গুণগত অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণও অনেক সময় অসাধ্য।
এই খালগুলো যখন মুক্ত ছিল, জঞ্জালহীন পানিতে পূর্ণ ছিল সে সময়ের কথা কল্পনা করলেও হয়তো স্বাস্থ্যবান ঢাকার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এসব খাল ধরে নৌকা চলত, মাছের জলকেলি শোভা পেত, এর পানি ব্যবহার করত আশপাশের লোকজন। যে কয়টি খাল এখনও টিকে আছে সেগুলোরও ত্রাহি অবস্থা। কল্যাণপুর খাল, আবদুল্লাহপুর খাল, দেগুন খাল, কাটাসুর খাল, বাউনিয়া খাল, মান্ডা খাল, শাহজাদপুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল নিত্য দখলদারিত্বের মাঝে টিকে আছে কোনো মতে। চলমান অবস্থা বজায় থাকলে এগুলোও হারিয়ে যেতে দেরি হবে না। সব জলাশয় যদি আমরা নিঃশেষ করে দিই তাহলে তপ্ত নগরীতে আগুন ছড়িয়ে পড়লে নেভানোর পানি পাব কোথায়?
বসবাসযোগ্য নগরীর স্বপ্ন নিয়ে যারা কাজ করেন তাঁরা হতাশ হয়েই বলছেন– নগরীর অভ্যন্তরে এবং আশপাশের খাল ও জলাভূমি নষ্ট করার ফলে ঢাকা যেমন শুকনো মৌসুমে হচ্ছে উত্তপ্ত, তেমনি বর্ষাকালে হয়ে পড়ছে জলাবদ্ধ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত সময়ে ঢাকার জলাবদ্ধতায় ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টি হলে এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ শহরে জলাবদ্ধতায় সবচেয়ে হুমকির সম্মুখীন দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকা এবং বিকল্প ব্যবস্থার অভাবে এসব মানুষ হারায় আশ্রয়স্থল।
পরিবেশবাদী সংগঠন, গবেষকরা ঢাকার হারানো জলাশয় নিয়ে বহুভাবে আশঙ্কা প্রকাশ করলেও তেমন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা দেখা যায়নি। হারিয়ে যাওয়া খাল-নদী পুনরুদ্ধার এবং এর প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়ার আর্জি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। লাভ হয়নি। বরং ঢাকা নগরীর পূর্ব দিকের নিম্নাঞ্চল ক্রমে ভরাট হয়েছে। জলাভূমি ভরাট করে পরিবেশগত পরিকল্পনা ছাড়াই আবাসন নির্মিত হয়েছে। এর ফলে নগরীর প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন যেমন ধ্বংস হয়েছে, তেমনি হারিয়ে গেছে জীববৈচিত্র্য।
ঢাকা নগরীর বিভিন্ন স্থানের নামের সঙ্গে এখনও জড়িয়ে আছে জলাভূমি আর বনভূমির সংযোগ। হাতিরঝিল, মতিঝিল যেমন জলাশয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি শাহবাগ, আরামবাগ, বনানী, সেগুনবাগিচা মনে করিয়ে দেয় ঢাকার পাখি ডাকা ইতিহাস। জীবের বেঁচে থাকার প্রধান নিয়ামক এবং জীবনের উৎস দুটোকে ধ্বংস করে কীভাবে আমরা এই ঢাকা শহরকে বসবাসযোগ্য নগরী হিসেবে কল্পনা করতে পারি? বসবাসযোগ্য নগরীতে কত শতাংশ এলাকা বৃক্ষ আচ্ছাদিত থাকবে, কতটুকু জলাভূমি থাকবে, কতটুকু উন্মুক্ত অঞ্চল থাকতে হবে তা পরিকল্পক এবং নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই জানা আছে। এখন প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছা।
ড. এ. এস. এম সাইফুল্লাহ : অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
saifullahasm@yahoo.com
মন্তব্য করুন