ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলা অবস্থায় ওপর থেকে রড পড়ে এক কিশোর নিহতের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। রাজধানীর মহাখালীর ওই ঘটনায় মামলা হওয়ার পর গত সোমবার রাতে মো. হাসান নামে ওই প্রকল্পের এক শ্রমিককে গ্রেপ্তার করেছে রেলওয়ে থানা পুলিশ। হাসান জানিয়েছেন, নিহত কিশোরের নাম সুমন। সে কড়াইল বস্তিতে থাকত। তিনি নিজেও কড়াইল এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, রড চোর চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রাণ গেছে ওই কিশোরের। ঘটনার দিন সোমবার রাতেই ওই প্রকল্পের বনানী এলাকার ইনচার্জ হাসিব হাসান বাদী হয়ে মামলাটি করেন। সেখানে হাসানকেই একমাত্র আসামি করা হয়েছে। কিশোরের মৃত্যু অবহেলাজনিত কারণে হতে পারে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা বনানী থানার উপপরিদর্শক মতিন বিশ্বাস সমকালকে বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অসাধু কর্মীদের যোগসাজশে একটি চক্র রড চুরি করতে পারে। সরানোর জন্য ওপর রড ফেলা হচ্ছিল। নিচে তা সংগ্রহ করতে আসে ওই কিশোর। রড চুরি করার জন্য কিশোরকে তারা ব্যবহার করতে পারে।
পুলিশের এক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার আসামিসহ বেশ কয়েকজন মিলে ওই প্রকল্পের রড চুরি করে কিশোরদের দিয়ে তারা সরানোর কাজ করতেন। ঘটনার দিনও এমন কিছুর জন্য ওই কিশোর আসে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরে ওপর থেকে ফেলা রড তার মাথায় দিয়ে ঢুকে গলার পাশ দিয়ে বেরিয়ে বুকে ঢুকে যায়। এই আঘাতেই হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।

তবে এ বিষয়ে গ্রেপ্তার হাসানের নামে আগে কোনো অভিযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে মামলার বাদী হাসিব হাসান বলেন, এ বিষয়ে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। কিন্তু ঘটনার দিন তার হাত থেকেই রড পরে দুর্ঘটনা বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তাকে আসামি করে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট আসার পরে তার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী বলেন, মঙ্গলবার আসামিকে আদালতে তোলা হয়। পরে আগামী ১ জুন শুনানির দিন ধার্য করে আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। আমরা নিহত কিশোরের বিস্তারিত পরিচয় শনাক্ত করার জন্য চেষ্টা করছি। তার পরিবারের কাউকে এখনও পাওয়া যায়নি। চুরির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমরাও শুনেছি। সেসব বিষয় নিয়ে তদন্তের কাজ চলছে। আর কিশোরকে যেহেতু এলাকার কেউ চেনে না। তার খোঁজ পেলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে চুরির কোনো ঘটনা থাকতে পারে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন দুর্ঘটনাস্থল মহাখালী রেলগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ২৮৬-২৮৭ পিলারের মাঝেখানে ওয়েট জয়েন্ট ছিদ্র দিয়ে রড নিচে ফেলানো হয়। সেগুলো রেললাইনের ওপর এসে পড়ে। পরে কুড়িয়ে গন্তব্যে নিয়ে যায় চোর চক্র। ওপর থেকে পড়া এ লোহার রড কমলাপুর-বিমানবন্দর লাইনে যাতায়াতকারী ট্রেনের ওপর পড়েও দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে।

আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সোমবার একই সময় দুটি রড নিচে পড়ে। একটি তার শরীরে বিঁধলেও আরেকটি নিচে ট্রেন লাইনে এসে পড়ে। ঘটনাস্থলের পাশ দিয়ে যাওয়া এক পথচারী ট্রেন আসা দেখে কিশোরকে সরিয়ে অন্য পাশে নিয়ে আসেন। পরে লোকজনের সহযোগিতায় প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

আশপাশের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রেন লাইনে কাজ চলা অবস্থায় নিরাপত্তাকর্মীরা পাহারায় থাকেন। এ ছাড়া ওপরে কাজ করার সময় বিভিন্ন জিনিসপত্র পড়ার ঘটনা ঘটলেও দুর্ঘটনা ঘটেনি। বনানী জোনের অফিসের সামনে ডান পাশে নিরাপত্তা পরিসংখ্যান বোর্ডে দেখা গেছে, ওই জোনে সর্বশেষ দুর্ঘটনা ঘটে ২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল। মেডিকেল ট্রিটমেন্ট নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে আটটি।

গতকাল মহাখালী রেলগেট এলাকা থেকে বনানী পর্যন্ত ওই প্রকল্প এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, দুর্ঘটনাস্থলে কোনো কাজ চলছে না। ওই স্থানে আগেই নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া এলাকাজুড়ে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচে নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করছেন। হ্যান্ডমাইক নিয়ে কাজ চলা এলাকায় পথচারীদের সতর্ক করছেন। আর ট্রেন আসার আগে হুইসেল বাজিয়ে ওপরে কাজ করা শ্রমিকদের সতর্ক করে দিচ্ছেন। এতে শ্রমিকরা ওপরে কাজ করা বন্ধ রাখছেন। ট্রেন চলে যাওয়ার পর একইভাবে ওপরে শ্রমিকদের জানানো হচ্ছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হাসান প্রকল্পের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে রড সরানোর কাজ করতেন। অবহেলাজনিত কারণে এই দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়। এতে সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন– প্রকল্পে কর্মরত নিরাপত্তা কর্মকর্তা রাকিব হোসেন, নিরাপত্তা পরিদর্শক সাহাদাত হোসেন ও নিরাপত্তাকর্মী আহসান হাবিব আকাশ। আহসান হাবিব বলেন, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কোনো কাজ হয়নি। ফলে সেখানে কোনো নিরাপত্তাকর্মী ছিল না।

এদিকে, গতকাল এ বিষয়ে গণমাধ্যমে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ। সেখানে বলা হয়, চুরির ঘটনায় ১৪ বছর বয়সী কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর থেকে নিচে রড ফেলছিল অসাধু শ্রমিকরা। ওই কিশোর প্রকল্প থেকে রড চুরিতে শ্রমিক চক্রকে সহায়তা করেছিল।





বিষয় : রড চোর চক্র

মন্তব্য করুন