
উড়িষ্যার বালেশ্বরের রেল দুর্ঘটনা ভারতের কয়েক বছরের মধ্যে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ঘটনার অন্যতম। শুক্রবারের এ দুর্ঘটনায় দুটি যাত্রীবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে কমপক্ষে ২৮৮ জন মারা গেছে এবং ৯০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। প্রথমে কলকাতাগামী বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনটি উড়িষ্যার বাহাঙ্গাবাজার এলাকায় লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। চেন্নাইগামী শালিমার-চেন্নাই সেন্ট্রাল করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটির ওই এলাকা পেরিয়ে যাওয়ার সময় লাইনচ্যুত ট্রেনের বগির সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনার পর সেখানে উদ্ধার চলছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী, জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ), উড়িষ্যার দুর্যোগকর্মী ও পুলিশ বাহিনী দুর্ঘটনাস্থলে রয়েছে।
এমন রেল দুর্ঘটনা ভারতে অস্বাভাবিক নয়। গত বছর প্রকাশিত ভারতের কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলের প্রতিবেদন মতে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত দশটি বড় দুর্ঘটনার সাতটিই ঘটেছে লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে। ২০২২ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় রেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৩৮.২ শতাংশ। প্রতিবেদনটি বলছে, এ সময়ে হয় রেল থেকে পড়ে, না হয় লাইনচ্যুত হয়ে ১১ হাজার ৩৬ জন নিহত হয়।
চালকের ত্রুটি, নাশকতা, সিগন্যাল গার্ডের দায়িত্বহীনতা ও কারিগরি ত্রুটিও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। গত জানুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে গুয়াহাটি এক্সপ্রেসের ১২টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার পর অন্তত ৯ জনের মৃত্যু এবং ৩৬ জন আহত হয়। ভারতে ২০২০ সালে প্রায় ১৩ হাজার ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে এবং প্রায় ১২ হাজার রেলযাত্রী নিহত হয়। ২০১৮ সালে আরেকটি বড় রেল দুর্ঘটনা ঘটে পাঞ্জাবের অমৃতসরে। তখন দশেরা উদযাপনের জন্য রেললাইনের পাশে মানুষ জমায়েত হয়, তাদের ওপর একটি যাত্রীবাহী ট্রেন ওঠায় ৫৯ জনের মৃত্যু এবং ৫৭ জন আহত হয়েছিল।
হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুসারে, রেলের লাইনচ্যুতির প্রধান কারণ ‘রেল ফ্র্যাকচার’। খুব গরম বা অধিক শীতে রেললাইনের প্রসারণ বা সংকোচনের কারণে এমনটি ঘটে। তবে লাইনচ্যুতি কেবল একটি কারণে হয় না। এর সঙ্গে তিনটি, চারটি বা পাঁচটি কারণ যুক্ত হলে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। সংকেত দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, যান্ত্রিক ত্রুটি ও পুরকৌশল ব্যর্থতার কারণে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়।
রক্ষণাবেক্ষণ এবং বরাদ্দের অভাবও ভারতীয় রেলওয়ে দুর্ঘটনার কারণ। ভারতের রেল বিশ্বের প্রাচীনতম ট্রেন নেটওয়ার্কগুলোর অন্যতম। রেল নেটওয়ার্ক অনেক বেশি প্রসারিত হলেও এর ওপর চাপ অত্যধিক। যে কারণে চলমান ট্রেনগুলোতে সুরক্ষার কাজ চালানোর ফুরসত কম। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যত লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ২৬ শতাংশের কারণ ছিল রেললাইন সংস্কারের জন্য তহবিলের ঘাটতি এবং বরাদ্দ থাকা তহবিলের যথাযথ ব্যবহার না করা। সেখানে নতুন রেল উদ্বোধনে ব্যয় হলেও সুরক্ষা ব্যবস্থা ও অবকাঠামো সংস্কারে যথাযথ ব্যয় হচ্ছে না। এর ফলে লাইনচ্যুতি ঠেকাতে রেললাইনের ব্যবস্থাপনা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টিতে কম নজর পড়ছে।
রেললাইনের অত্যধিক ব্যবহারের পাশাপাশি কোচে ওভারলোডিংকেও উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতের চারটি প্রধান স্টেশন– দিল্লি, হাওড়া, মুম্বাই এবং চেন্নাইয়ের মধ্যকার ট্রাঙ্ক লাইনগুলোতে বছরের পর বছর ধরে নতুন কোনো লাইন সংযোজন হয়নি বা লাইন দ্বিগুণ করতে দেখা যায়নি।
ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী ২০১৬ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস নিবন্ধে পরামর্শ দিয়েছিলেন, রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ আয়ের ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে সরকারকে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বস্তুত রেললাইন উন্নততর করা এবং আরও লাইন নির্মাণসহ অবকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অতিরিক্ত চাপ সহ্য করার জন্য অবকাঠামোর সক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য একটি সঠিক জরিপ করা উচিত। ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ভারতীয় রেলওয়ের জন্য ২ দশমিক ৪০ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের ঘোষণা করেছিলেন, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
ভারত সরকারকে রেলওয়েতে আরও অধিক ব্যয়ের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, রেলওয়ের অবকাঠামোগত খরচ অনেক বেশি, সেজন্য কেবল রেলওয়ের তা বহন করা কঠিন। তবে আরেক রেল বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভারতীয় রেলওয়ের আয় এবং ব্যয় সমান হওয়ার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে এবং এর সক্ষমতার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ব্যবহার করা উচিত, তবেই রেল লাইনচ্যুতির নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং রেল নেটওয়ার্কের আরও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
ইশা মেহরোত্রা: ফার্স্টপোস্টের সাংবাদিক; ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন